সবুজ, নির্মল ও জনবান্ধব স্থান কিশোরগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত গুরুদয়াল সরকারি কলেজ মাঠ। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শহরের সাধারণ মানুষ এই মাঠে আসেন অবসর সময় কাটাতে, শ্বাস নিতে নির্মল বাতাসে। অথচ এখন সেই মাঠে চোখে পড়ে প্লাস্টিক, ময়লা-আবর্জনা, খাবারের প্যাকেট আর দখলদারদের অবাধ দৌরাত্ম্য।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে, কলেজ মাঠে একের পর এক গড়ে তোলা হয়েছে অস্থায়ী দোকান। ফুচকা, চটপটি, বার্গার, কোমল পানীয় সবই মিলছে। কিন্তু কোনো রকম নিয়মনীতি না মেনেই চলছে এই দোকানগুলো। কোনো দোকানের নেই পৌরসভার অনুমতি, নেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে খাবার প্রস্তুতের ব্যবস্থা।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ, এসব দোকানে সাধারণ মানের খাবার বিক্রি করা হলেও দাম রাখা হচ্ছে অস্বাভাবিক। যারা খাবারের দাম বা মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে নারী ও শিশুদের প্রতিও রয়েছে অশোভন দৃষ্টিভঙ্গি ও দুর্ব্যবহার।
মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে আসা শরিফুল ইসলাম বলেন, আমার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে সোমবার বিকালে গুরুদয়াল সরকারি কলেজ মাঠে সময় কাটাতে গিয়েছিলাম। মাঠে ঘোরাঘুরির সময় মেয়ের ইচ্ছে হলো ফুচকা খাবে। আমি কাছে থাকা একটি দোকান থেকে ফুচকা কিনতে গেলে দাম অত্যধিক চাওয়ায় শুধুমাত্র জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাই, এত দাম কেন? এই প্রশ্নটুকুর জবাবে দোকানদার উত্তেজিত হয়ে গালিগালাজ শুরু করে এবং অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলতে থাকে।
আমি তাকে শান্তভাবে বলি, ভালোভাবে কথা বলুন ভাই। তখনই আশেপাশের আরো সাত-আটজন দোকানি এসে আমাকে ঘিরে ধরে হুমকি-ধামকি দিতে শুরু করে। আমি বাধ্য হয়ে চুপ থাকি। আশেপাশে অনেক মানুষ থাকলেও কেউ কিছু বলেনি ভয়ের কারণে নিশ্চুপ থাকে সবাই। কথা কাটাকাটির সময় দোকানিরা দাবি করে, তারা নাকি চাঁদা দিয়ে কলেজ মাঠে দোকান চালাচ্ছেন তাদের কিছু বলার অধিকার কারো নেই, সরকারি জায়গায় এমন অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা, ভদ্রতা ও অধিকারকে এভাবে পদদলিত করার সুযোগ কীভাবে পায় তারা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এমদাদুল হক (স্কুল শিক্ষক) বলেন, আমি ছেলে ও ছেলের আম্মুকে নিয়ে আসছি, দোকানদাররা একজোট পরিবারের সামনে যদি আমাকেও অপমান করে তাই দূর থেকে দেখেছি বিষয়টা খুবই দুঃখজনক, আমি প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি, এই ধরনের দখলদারিত্ব, অবৈধ চাঁদাবাজি ও জনসাধারণের উপর মানসিক সন্ত্রাস বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হোক। গুরুদয়াল কলেজ মাঠ যেন পুনরায় পরিবার ও শিশুদের বিনোদনের একটি নিরাপদ স্থান হিসেবে গড়ে ওঠে সেই উদ্যোগ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া জরুরি।
খেলাধুলা ও হাঁটাহাঁটির পরিবেশ তো নেই-ই, উলটো মাঠজুড়ে বসার স্থানে জমেছে প্লাস্টিকের গ্লাস, চিপসের খালি প্যাকেট, খাবারের থালা। কোথাও নেই নির্দিষ্ট আবর্জনার ঝুড়ি, নেই কোনো পরিচ্ছন্নতা কর্মী। পরিবেশবিদ সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলছেন এভাবে চলতে থাকলে এই মাঠ এক সময় মশা, দুর্গন্ধ ও রোগের উৎসস্থলে পরিণত হবে।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ পৌরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গুরুদয়াল কলেজ মাঠে যারা দোকান দিচ্ছেন, তাদের কাউকে নিয়মমাফিক অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। অচিরেই অভিযান চালানো হবে এবং অবৈধ দোকান সরিয়ে ফেলা হবে।
একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী রোমা আক্তার বলেন, শহরের প্রাণকেন্দ্রের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জায়গাকে ঘিরে যখন এমন অনিয়ম, দখলদারিত্ব ও বিশৃঙ্খলা চলে, তখন স্থানীয় প্রশাসন ও পৌর কর্তৃপক্ষ ঠিক কোথায়? অবিলম্বে কলেজ মাঠ থেকে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ, পরিবেশ রক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা এই ঐতিহাসিক মাঠ কেবল ইতিহাস হয়েই থাকবে, হারিয়ে যাবে বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঠিকানা।
স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ এবং পৌরসভার তদারকি ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকেরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আওতায় থাকা এমন একটি মাঠ কীভাবে বাণিজ্যিক স্থানে রূপান্তরিত হয় কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে? তারা আশা করছেন, কলেজ মাঠের আসল সৌন্দর্য ও উদ্দেশ্য পুনরুদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।
কেকে/এএম