মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকরের হুমকি মাথায় রেখে বাংলাদেশ সরকার বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস এবং কূটনৈতিক টানাপোড়েন এড়াতে আমদানি বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি ‘সুবিবেচনাপ্রসূত বাণিজ্য-সম্পর্ক’ গড়ে তোলা সম্ভব, যা শুল্ক সুবিধা আদায়ে সহায়ক হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা বড় অঙ্কের শুল্ক কমানোর জন্য আলোচনার মধ্যেই মার্কিন কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজের ক্রয়াদেশ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, এলএনজি, সয়াবিন তেলা ও তুলা কেনার পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তুলা আমদানির পর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মিরসরাই ইপিজেডে ৬০০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা, যাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই ৩৫ শতাংশ শুল্কের বোঝা থেকে বাংলাদেশকে রেহাই দেয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণায় সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় চলতি মাসেই বাংলাদেশ ৭ লাখ টন গম আমদানির চুক্তি সম্পন্ন করেছে, যা আগামী পাঁচ বছরে ধাপে ধাপে সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া তৈরি পোশাক খাতের জন্য আমেরিকান তুলা আমদানির পরিমাণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা সম্প্রসারণ এবং দ্রুত কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন চলছে।
রোববার বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, শুল্ক চুক্তির খসড়া পাওয়ার পর কয়েক দফায় আমরা কাজ করেছি। ওয়াশিংটনে দুই দফা সরাসরি এবং অনলাইনে আলোচনা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠকের পর ২৩ জুলাই আমরা আমাদের চূড়ান্ত অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছি।
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সময় চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) অফিসে ২৯ ও ৩০ জুলাই সরাসরি বৈঠক হবে।
সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাণিজ্য উপদেষ্টা, নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও বাণিজ্য সচিব উপস্থিত থাকবেন। ৩১ তারিখও একটি সভা হতে পারে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল আগামীকাল সন্ধ্যায় রওনা দেবে। যেহেতু তাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে ১ আগস্টের মধ্যেই হয়তো শুল্কের বিষয়ে ফলাফল হয়ে যাবে।’
বোয়িং বিমান কেনার ব্যাপারে বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘বোয়িংয়ের ব্যবসা যুক্তরাষ্ট্র সরকার নয়, বোয়িং কোম্পানি করে। বাংলাদেশ বোয়িং থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার জন্য অর্ডার দিয়েছে। ভারত, ভিয়েতনাম ১০০টি করে অর্ডার দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া দিয়েছে ৫০টি। এরকম অর্ডার বিভিন্ন দেশ দিয়েছে। বোয়িং কোম্পানি তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী সরবরাহ করবে। অর্ডারের বোয়িং পেতে অনেক সময় লাগবে। যাকে আগে অর্ডার দিয়েছে তাদের আগে দেবে কিংবা প্রতিষ্ঠানটি তাদের ব্যবসার ধরন অনুযায়ী বিমান সরবরাহ করবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অতি দ্রুত কিছু বোয়িং দরকার। আগামী দু-এক বছরের মধ্যে হয়তো কিছু বিমান পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ বিমানের বহর বাড়াতে হবে। এই পরিকল্পনা সরকারের আগে থেকেই ছিল। আগে ১৪টি বোয়িংয়ের অর্ডার ছিল। রেসিপ্রোকাল ইস্যুতে ২৫টি করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার, হ্যাঙ্গার বোয়িং নির্ভর। তাই বোয়িং কিনতে হবে। পাশাপাশি এয়ারবাস বা অন্যান্য বিমান যে কিনব না, তেমন নয়। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকেই কেনা হবে সেটি বলা হয়নি।’
গম আমদানির প্রসঙ্গে মাহবুবুর রহমান জানান, সরকারি ও বেসরকারি খাতে বছরে প্রায় ৯ মিলিয়ন টন গম আমদানি করা হয়। কখনোই একটি দেশ থেকে পুরোটা আনা হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেও আমদানি হতো। এখন রেড সি এলাকায় পরিস্থিতির কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা আগের মতো নেই। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার ওপর নির্ভরশীলতা রাষ্ট্রীয় স্বার্থেই প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ‘রাশিয়া, ইউক্রেন থেকে গম আনা হয়। কিন্তু তারা আমাদের কাছ থেকে নেয় না। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ৮ বিলিয়ন কেনে। যারা আমার কাছ থেকে কেনে, সুতরাং তার কাছ থেকেও আমাদের কেনা উচিত। আমাদের একটু অগ্রসর হওয়া উচিত। বেসরকারি খাতকে অনুরোধ করেছি সেখান থেকে কিনে শুল্ক ইস্যুতে সহায়তার জন্য।’
তিনি আরো জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে সয়াবিন ও তুলা আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা সয়াবিন আমদানির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। তুলা আমদানি নিয়ে আগেই আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির মধ্যে বিনিয়োগের বিষয় থাকলেও সেটিকে মুখ্য বিষয় মনে করছেন না বাণিজ্য সচিব। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক বাণিজ্য ঘাটতি ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। তাদের উদ্দেশ্য এই বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, সেজন্যই রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ আরোপ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির কারণে বাজারে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘সুবিধা আছে বলেই যুক্তরাষ্ট্র থেকেই বিভিন্ন জিনিস আমদানি করা হয়। অসুবিধা থাকলে ব্যবসায়ীরা আনত না। সরকার কাউকে চাপ দিচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন জিনিস কেনার প্রভাব বাজারে পড়বে না।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রপ্তানি খাত যেমন যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর, তেমনি আমদানির ঘাটতিও দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি যে ‘রেসিপ্রক্যাল ট্যারিফ’ নীতির ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে যেসব দেশ আমেরিকান পণ্যে শুল্ক আরোপ করে বা আমদানি কমায়, তাদের পণ্যেও উচ্চ হারে শুল্ক বসানো হবে। এ নীতির বলয়ে পড়ে বাংলাদেশও।
বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিটিএমএ ইতোমধ্যে আমেরিকান তুলা থেকে তৈরি পোশাকে শুল্ক ছাড়ের দাবি জানিয়েছে। আমদানি বাড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যেও বাংলাদেশকে নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে বলে আশা করছেন তারা।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি শুধু বাণিজ্যিক পদক্ষেপ নয়, বরং এক ধরনের কূটনৈতিক বিনিয়োগ, যা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্ক তৈরিতে সহায়ক হবে। তবে তারা সতর্ক করেছেন, আমদানি বাড়াতে গিয়ে যেন বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি না হয়।
কেকে/ এমএস