গত বছরের জুলাই গণঅভুত্থানে ছাত্র-জনতার তোপের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিগত হাসিনা সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পাশাপাশি দেশের অনিয়ম ও সহিংসতা বন্ধ হবে। নতুন আঙ্গিকে সাজবে দেশ, মিলবে সুশাসন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় ১ বছর হতে চললেও সেই প্রত্যাশা এখনো অধরাই রয়ে গেছে। বরং দেশের দুর্নীতি, অনিয়ম ও সহিংসতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষ করে সম্প্রতি পুরান ঢাকায় ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ডের পর অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। অনেকের মতে, সাম্প্রতিক দেশের অস্থিতিশীলতা জন্য দায়ী হচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা। তাদের অপরিপক্ব মন্তব্য ও সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে এসব সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া উপদেষ্টাদের ভূমিকা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করছেন রাজনৈতিক নেতারাও।
এর আগে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের নানা বিতর্কিত মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছিল। নানা ইস্যুতে বিতর্কের জন্ম দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ আরো কয়েকজন উপদেষ্টাও। সবশেষ পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ী হত্যার ঘটনায় ‘প্রস্তর যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ’ লিখে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে স্ট্যাটাস দেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। আর এ স্ট্যাটাসকে ফিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সব খানে শুরু হয় কঠোর সমালোচনা।
একই ইস্যুতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘সরকার বারবার তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে, সেটি হচ্ছে মব জাস্টিস সরকার কোনোভাবেই বরদাশত করে না। এখন যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর সঙ্গে কোনো সরকার বা সরকারি দলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যখনই মব জাস্টিস ঘটছে, অন্তত গত ৩-৪ মাসে আপনারা দেখেছেন যেখানেই খবর পাচ্ছি, সেখানেই আমরা আসামিকে গ্রেফতার করেছি এবং কোনো আসামি আর বের হতে পারছে না।’
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা এ বক্তব্যকে ঘিরেও শুরু হয় সমালোচনা। সরকার বা সরকারি দলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই এই বক্তব্য ‘সরকারি দল’ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন এটাও স্পষ্ট নয়। বিশ্লেষকদের মতে, ‘বর্তমান সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করে না। এ পরিস্থিতিতে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টার এমন মন্তব্য রাজনৈতিক মহলে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সবাই জানতে চায় এই সরকারি দলটি কে!’
অনেকেই বলছে, যেখানে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা-ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে সরকার। সেখানে তাদের সে বিষয়ে নজর না দিয়ে উল্টো দায় এড়ানো পাশাপাশি বিষয়টিকে উসকে দিচ্ছেন তারা।
এদিকে আসিফ মাহমুদের পোস্টের স্ক্রিনশট নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করে উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে নাট্য নির্মাতা আশফাক নিপুণ লেখেন, ‘আপনার মতো তরুণদের দিকে আমার মতো পুরো দেশ তাকিয়ে আছে। এসব চাঁদাবাজি, দখলবাজির জের ধরে খুনোখুনি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় আপনার সরকারের ওপরও বর্তায়। দায় না নিয়ে হাসান মাহমুদের মতো দায় চাপানোর চটকদার রাজনীতি আমরা নতুন কোনো সরকারের ভেতর আর দেখতে চাই না।’
আশফাক নিপুণের করা পোস্ট চোখ এড়ায়নি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার। নির্মাতার পোস্টের প্রায় এক ঘণ্টা পর ওই পোস্টে মন্তব্য করলেন আসিফ মাহমুদ। মন্তব্যের ঘরে আসিফ মাহমুদ লেখেন, ‘কঠোর হস্তে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি নিপুণ ভাই।’
এরপর উপদেষ্টা লিখেছেন, ‘মুরাদনগরে হাতেনাতে ধরার পর চাঁদাবাজকে ছাড়াতে থানায় হামলা করে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। ৩ ঘণ্টার হামলায় ভাঙচুর, পুলিশসহ সিভিলিয়ান আহত হয়। কুমিল্লা থেকে এডিশনাল ফোর্স আর যৌথ বাহিনী এসে থানা রক্ষা করে। পুলিশবাদী মামলা হয়। স্থানীয় পুলিশকে কঠোর হতে নির্দেশ দেই। সে ঘটনায় ৭ জন গ্রেফতার হয় (যদিও মাসখানেকের মধ্যেই জামিন হয়ে যায়)।’
আসিফ মাহমুদ আরো লেখেন, ‘তো এই কঠোর হওয়ার অপরাধে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে দলটির একজন উচ্চ পর্যায়ের নেতা আমার নামে অভিযোগ করে যে, আমার যন্ত্রণায় নাকি মুরাদনগরের বিএনপির লোকেরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। আরো মুশকিল হলো আমাদের এ সরকারের সবাই তো বিপ্লবী না, কঠোর হওয়াটাও মাঝেমধ্যে একরকম অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। আবার জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার গুরুদায়িত্বও যেন একমাত্র সরকারেরই।’
সর্বশেষে উপদেষ্টা লেখেন, ‘মিডিয়ায় এসে বলবে ইন্টেরিম ব্যবস্থা নেয় না কেন আর অভ্যন্তরীণ বৈঠকে সন্ত্রাসীদের ইমিউনিটি দেবে। সন্ত্রাসীরা উচ্চ পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আইনশৃঙ্খলা ভালো হবে কীভাবে? আর এ প্রশাসনযন্ত্রের ৫-১০% লোক ছাড়া বাকি সব চরিত্রগত ভাবে ক্ষমতার গোলাম। এ সরকার আর কদিন।’
অন্যদিকে ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যার ঘটনায় সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। তিনি বলেন, সোহাগের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, আমি যদি প্রশ্ন করি ১০০ মিটারের মধ্যে আনসার ক্যাম্প তারা কী করল? আমি যদি প্রশ্ন করি, পুলিশ কী করল? আমি যদি প্রশ্ন করি, ভিডিও না আসা পর্যন্ত সরকার কী করল? দে হ্যাভ টু আনসার ইট। রুমিন ফারহানা বলেন, চেয়ারে বসে থাকতে ভালো লাগে, এটা আমরাও বুঝি। চেয়ারের মজা যদি নিতে হয়, চেয়ারের দায়িত্বও নিতে হবে। এ দেশের মানুষ সামান্য নিরাপত্তা চায়। খুব বেশি কিছু চায় না। গত ৯ মাসে আমরা কী দেখলাম? বাংলাদেশে একটি নতুন সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। মবোক্রেসি। হুরহুর করে ২০-৩০ জন মানুষ আরেকটা মানুষের ওপর হামলে পড়ে। হতে পারে তার সঙ্গে তার ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, হতে পারে তার সঙ্গে তার রাজনৈতিক মতের অমিল আছে। রিপোর্ট বলছে, এর সঙ্গে অর্থনীতি জড়িত, অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে ১০-২০ জন ভাড়া করে এভাবে মব তৈরি করা হয়।
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে রুমিন ফারহানা বলেন, যেটুক ঐকমত্য হয়েছে সেটুকুই যথেষ্টের বেশি। বাকি ব্যাপার ১৮ কোটি মানুষ, যারা এই দেশে জন্মেছে, এই দেশেই থাকবে, এ দেশেই তারা মরবে তাদের হাতে ছেড়ে দেন। গত শনিবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘ছাত্র, শ্রমিক ও জনতার গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি-বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
কেকে/ এমএস