রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হলো ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আয়োজিত ‘মহাসমাবেশ’। গতকাল শনিবার লাখো জনতার অংশগ্রহণে জনসমুদ্রে রূপ নেয় এই সমাবেশ। দলটির আমির চরমোনাই পীরের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এই মহাসমাবেশে রাষ্ট্র সংস্কার, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) জাতীয় নির্বাচন আয়োজন এবং পতিত ফ্যাসিস্ট শাসকদের বিচারসহ ১৬ দফা ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়।
সমাবেশ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় সকাল ১০টায়, যদিও নির্ধারিত সময় ছিল দুপুর ২টা। ভোর থেকেই সারা দেশ থেকে আগত নেতাকর্মীদের ঢল নামে। সকাল ৮টায় মূল মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। শাহবাগ, দোয়েল চত্বর, পল্টন মোড়, কাকরাইল মোড় পর্যন্ত রাস্তা জনতার ভিড় ছড়িয়ে পড়ে।
পিআর নিয়ে গণঐকমত্য তৈরি হয়েছে, পিআর প্রশ্নে গণভোট দিতে হবে জানিয়ে সমাবেশ ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, জুলাইয়ের আকাক্সক্ষা ছিল স্বৈরাচারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠন করা। এটা করতে গেলে রাষ্ট্র পরিচালনায় দেশের সকল নাগরিকের মতামতের প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য পিআর পদ্ধতি-ই একমাত্র সমাধান।
তিনি বলেন, দেশের সকল মানুষের ভোটের দাম সমান। কারো ভোট যাতে অবমূল্যায়ন না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তাই আগামী নির্বাচনে সংসদের উভয়কক্ষে অবশ্যই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তাদের সেই অনুপাতে আসন থাকবে। এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় সকলের মতের প্রতিফলন ঘটবে। কোন দল জালেম হওয়ার সুযোগ পাবে না। এটা জেনজির দাবি। এটা এখন জনগণের দাবি। দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের দাবি। সকল ধর্মের মানুষেরও দাবি। আজকের মঞ্চ এটা আবারো প্রমাণ করেছে।
চরমোনাই পীর বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানকে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কারণ দাবি করে বলেন, ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধান ছিল দেশের মানুষের বোধ-বিশ্বাস ও গণআকাক্সক্ষাবিরোধী। সেই সংবিধান রচয়িতাদের স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করার ম্যান্ডেটই ছিল না। তারা ভিনদেশের সংবিধান অনুসরণ করেছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। কোনক্ষেত্রেই কাক্সিক্ষত সমৃদ্ধি ও উন্নতি হয় নাই। রাজনৈতিক সংস্কৃতি কলুষিত হয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হল- সংবিধান মেনেই স্বৈরাচার তৈরি হয়েছে।
সমাবেশে হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামানিক, বোধিজ্ঞান ভাবনাকেন্দ্রের সভাপতি দয়াল কুমার বড়ুয়া, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিওসহ বিভিন্ন ধর্মের শীর্ষ নেতারা অংশগ্রহণ করেন। তারা পিআর পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নেন এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় ইসলামী আন্দোলনের অঙ্গীকারকে স্বাগত জানান।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরোয়ার, নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমাদ আব্দুল কাদের, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, গণঅধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নূর, নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মূসা বিন ইজহার, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন রাজি, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম ও খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানি।
সমাবেশের শেষ ভাগে ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান ১৬ দফা প্রস্তাবনা পাঠ করেন।
ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- দলের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম, মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ মাদানী, মুহাদ্দিস আব্দুল হক আজাদ, দলের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ, মাওলানা মুহাম্মদ ইমতিয়াজ আলম, মুফতি এছহাক মুহাম্মদ আবুল খায়ের, মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম, কেএম আতিকুর রহমান। পুরো সমাবেশ পরিচালনায় ছিলেন দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) শাহ ইফতেখার তারিক ও সহ-প্রচার সম্পাদক মাওলানা কেএম শরীয়াতুল্লাহ।
উল্লেখ্য, এদিকে মহাসমাবেশে যোগ দিতে আসার পথে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর ও টাঙ্গাইলে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় ছয় নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে শ্রীনগরে পাঁচজন এবং টাঙ্গাইলে একজন নিহত হন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অনেকে। ঘটনার পর এক শোকবার্তায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, মহাসমাবেশে অংশ নিতে আসার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের ছয় সঙ্গী শাহাদাতবরণ করেছেন। এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক। আমি তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, শহিদদের রক্ত বৃথা যাবে না। এই আত্মত্যাগ আমাদের আন্দোলন আরো বেগবান করবে। আমরা তাদের পরিবারের পাশে আছি এবং সর্বোচ্চ সহযোগিতা নিশ্চিত করব।
কেকে/এআর