সারা জীবনের অর্জিত জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে প্রশান্তি পাওয়ার নাম শিক্ষক। যাকে পথপ্রদর্শক, অভিভাবক ও অটুট সমর্থনের মূর্ত প্রতীক বলা হয়। একজন শিক্ষক গবেষণা ও পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, নৈতিকতা ও দক্ষতায় উন্নত করে ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তোলেন। পাঠদান ভিন্ন শিক্ষক যদি রাজনীতিতে জড়িয়ে যায় তাহলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। কারণ রাজনীতি যেখানে বসবাস করে তার প্রতিবেশী হিসাবে অ্যাবিলিটি, পাওয়ার, ইন্টারেস্ট, ডমিন্যান্স ইত্যাদি শব্দগুলো বসবাস করে যা শিক্ষক বৈশিষ্ট্যের রেসপনসিবল, অনেস্ট, কেয়ারিং শব্দের সঙ্গে বেমানান। স্কুল পর্যায়ে শিক্ষক রাজনীতির প্রভাব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত না হলেও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বেশ লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের একটা বড় অংশ দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। শিক্ষক রাজনীতির প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে নীল, সাদা, মেরুন, জাতীয় শিক্ষক ফোরাম, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ দলগুলো অন্যতম। এসব দল মূল রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের ভিত্তিতে গঠিত। যার মূল কাজ দলীয় অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করা। শিক্ষকের প্রধান কাজ পড়ানো আর গবেষণা করা। শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষা প্রদানে শিক্ষককে প্রতিনিয়ত অধ্যয়ন করতে হয়। যদি রাজনীতির পিছনে মূল্যবান সময় ব্যয় করে তাহলে অধ্যয়ন করবে কখন?
শিক্ষকদের যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনি শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কেন? বলবে—শিক্ষার মান উন্নয়ন, দেশের কল্যাণ আর জাতিকে উন্নতির চূড়ায় পৌঁছানোর জন্য। মূলত নিজের স্বার্থ উদ্ধার আর প্রশাসনিক পদ-পদবি পাওয়ার জন্য দলীয় রাজনীতি করে থাকে। দেশের স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিন্ডিকেট প্রতিনিধি, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সদস্য, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যান নির্বাচনসহ অনেক ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যোগ্যতার ভিত্তিতে এসব প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার কথা থাকলেও তা হয় না। দলীয় ম্যান্ডেটে নির্বাচন করলে স্ব-দলের সবাই একজনকে মনোনীত করে এবং তাকে ভোট দিয়ে বিজিত করে। কার্যত দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য নির্বাচনের প্রত্যেক স্তরে শিক্ষক ফোরামগুলো এভাবেই কাজ করে যায়। শিক্ষক রাজনীতি শিক্ষার্থীদের কোনো কাজে আসে না। নির্বাচিত শিক্ষক তার অনুগতদের নিয়ে স্বকর্মসাধন করে। যেমন হলের প্রভোস্ট নিজ দলের অনুসারীদের নিয়ে হলের সার্বিক কাজ পরিচালনা করে তেমনি ছাত্র উপদেষ্টা, প্রক্টর, রেজিস্ট্রার, উপউপাচার্য ও উপাচার্যসহ প্রত্যেক স্টেকহোল্ডার নিজ দলের অনুগতদের নিয়ে প্রশাসনিক কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এক্ষেত্রে যোগ্যতা আর দক্ষতার চেয়ে দলীয় প্রাধান্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনেকেই শিক্ষার্থী অবস্থায় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। দলীয় প্রভাবে শিক্ষক হয়। তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে দলীয় অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করা। পুরো ছাত্রজীবন দলের চাটুকারিতা করে তেমন পড়াশোনা করা হয়ে ওঠে না। কখনো সিজিপিএ কমিয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পরিবর্তন করে, কখনো দরদামের অঙ্ক বসিয়ে বিশেষ কায়দায় অনুগত উচ্চ প্রশাসন তাদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। এ পন্থা অবলম্বিত শিক্ষকগণ স্বল্পদিনেই কর্তৃত্ব দেখিয়ে পদ-পদবি আর নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। ফলে আদর্শ মানুষ গড়ার কাজটা তার দ্বারা আর হয়ে ওঠে না। শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন দল-মতের শিক্ষার্থী থাকে এবং নিজ দলের আদর্শ লালনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতের সুসম্পর্ক গড়ে উঠলেও অন্যদের সঙ্গে বিপরীতমুখী সম্পর্ক বজায় থাকে।
আপাতদৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বলা হয়। স্বজনপ্রীতি, সমসাময়িক রাজনীতির সঙ্গে তার সম্পর্ক, পরিবারের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে নিয়োগকৃত শিক্ষক প্রকৃতপক্ষেই কি দেশের বুদ্ধিজীবী? দলীয় রাজনীতির রোষানলে পড়ে দিনকে দিন অযোগ্য শিক্ষকদের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। স্বল্প জ্ঞানসম্পন্ন, অযোগ্য ও নিজে আলোকিত না হওয়ায় সে ছাত্রছাত্রীদের আলোর পথ দেখাতে পারে না। শিক্ষার্থীরাও জানে এমন শিক্ষকের ক্লাস থেকে সে কখনো কিছু অর্জন করতে পারবে না তবুও অ্যাটেনডেন্স মার্ক পাওয়ার জন্য ক্লাসে হাজির হয়। শিক্ষকও জানে একবার শিক্ষক হয়ে গেলে তাকে বহিষ্কার করা প্রায় অসম্ভব তাই আর তার পড়াশোনার প্রয়োজন পড়ে না। দলীয় ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা এসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বাচ্ছন্দ্যে অভিযোগ বা নালিশ করতে পারে না। এমতাবস্থায় সুপ্ত মেধা বিকশিত না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আবার মূলদলের পালাবদলে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হয়। নতুন সরকারের অনুগত শিক্ষকদের নিয়ে প্রশাসন গঠন করা হয়। হাউজ টিউটর থেকে উপাচার্য প্রত্যেক স্তরেই নিজস্ব ম্যান পাওয়ারের বলয় তৈরি করা হয়। শিক্ষকরা সমাজ, দর্শন, রাজনীতি, রাষ্ট্র বিনির্মাণ নিয়ে ভাববে এবং নিজেদের ধ্যানধারণা দিয়ে বিশ্বের দরবারে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ও নিরক্ষর মানুষ যেভাবে দলান্ধ রাজনীতি করে শিক্ষকদের পক্ষে কি তা মানায়? যেখানে নিজস্ব মতের গুরুত্ব না দিয়ে দলকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, সর্বদায় ওপর মহলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, দলের প্রয়োজনে শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্তকেও নাকচ করে দিতে হয় সেখানে কি শিক্ষক আর কৃষক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য থাকে? এই লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষক রাজনীতি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে। যার ফলে মেধাবী ছাত্রদের বড় অংশ বিদেশে পাড়ি দেয়। ইউনেস্কোর তথ্যমতে প্রতি বছর ৭০ থেকে ৯০ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য উন্নত দেশে গমন করে। তার মধ্যে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বদেশে ফিরে আসে না। ওই দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। মেধা পাচার দেশের জন্য সর্বোচ্চ ক্ষতি। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল ইরানের কাছে মাথানত করার অন্যতম কারণ প্রযুক্তি, পরমাণু বোমা বা মিসাইলে ইরান ইসরায়েলের থেকে এগিয়ে। কারণ তারা নোংরা রাজনীতি থেকে মেধাকে মূল্যায়ন দিয়ে মেধাবীদের কদর করতে জানে। এভাবে উন্নত দেশের সুযোগ সুবিধায় আকৃষ্ট হয়ে হাজার হাজার মেধাবী বাংলাদেশ ত্যাগ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মোটা অঙ্কের বেতনের পাশাপাশি ঈদ, পূজা, নববর্ষ, চিকিৎসা, গবেষণা ও ভ্রমণ ভাতাসহ আবাসনের সুযোগ, পরিবহনের সুবিধা, গবেষণা ছুটি ইত্যাদি পেয়ে থাকেন। ইচ্ছাধীন ক্লাস নেওয়ার সুবিধাও থাকে। আর যদি স্বদলের শিক্ষক বিভাগীয় প্রধান হয় তাহলে ক্লাস না নিলেও তাকে কারো কাছে কৈফিয়ত বা জবাবদিহি করতে হয় না। একসময় যোগ্যতার ভিত্তিতে উপাচার্য নিয়োগ হলে সচিবরাও তাকে স্যার ডাকত, বর্তমানে দলীয় প্রভাবে তার উল্টো চিত্র লক্ষ্য করা যায়। সুযোগ-সুবিধায় মধ্য যুগের জমিদারদের সঙ্গে শিক্ষকদের তুলনা করা যায়। সামান্ত শিক্ষক বললেও ভুল হবে না। কারণ দলের অধীনে স্বশিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের মাঝে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে কাজ করেন। পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই দেখবেন সাবেক রেজিস্ট্রার, উপউপাচার্য, উপাচার্য ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার পরিবর্তে ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও আর্থিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে টাকার পাহাড় গড়ে তোলেন। যার ফলে যোগ্য ও মেধাবীদের উৎসাহ কমে যাচ্ছে এবং শিক্ষার মান নিম্নমুখী হচ্ছে। বিশ্ব মানের শিক্ষার্থী তৈরি করতে প্রয়োজন নিরপেক্ষ শিক্ষা প্রদান। নিরপেক্ষ শিক্ষা প্রদানে শিক্ষক সব কিছুর ঊর্ধ্বে থাকবে, সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলবে। শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মূল্যবোধ, সততা, ও চিন্তাশক্তি গঠনে সহায়ক হবে। এছাড়া তারা সমাজ গঠনে, মানবসম্পদ উন্নয়নে এবং জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে একজন আদর্শ মেন্টরের ভূমিকা পালন করবে। সুষ্ঠু শিক্ষা প্রদানে দলীয় শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
কেকে/এএম