সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে সুগন্ধি চালের হরেক রকমের খাবার আদিকাল থেকেই ব্যাপক জনপ্রিয়। বাঙালির রসনা বিলাসে পোলাও, বিরিয়ানি, কাচ্চি, তেহারি, জর্দ্দা ও পায়েস রান্না এবং পিঠাপুলি তৈরিতে সুগন্ধি চালের বিকল্প নেই। এটিকে বাংলার কৃষকের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেন বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ।
শহরের বাজার ও পাড়া-মহল্লার মুদি দোকান সব জায়গাতেই চিনিগুঁড়া নামে যে চাল বিক্রি চলছে সেগুলো রান্নায় পাওয়া যায় না পুরনো স্বাদ ও গন্ধ। সুগন্ধির নামে রাসায়নিক কেমিক্যালের কৃত্রিম ফ্লেভারে (স্বাধ) ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই চালের ঘ্রাণ ও জাত নিয়ে চলছে ধান-চালের রাজ্য বলে পরিচিত উত্তরের জেলা নওগাঁর চালকল মালিকদের চালবাজি। একই চাল কর্পোরেট মোড়কে প্যাকেজিং এর পর কেজিতে দাম বাড়ছে ৪০-৫০ টাকা।
চাষিরা বলছেন, মিনিকেট নাজির শাইলের মতো ভাগ্যবরণ করেছে চিনিআতপ বা চিনিগুঁড়া চালও। স্থানীয় জাতের ধান এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। তবে বাজারে চালের ছড়াছড়ি। সুগন্ধি জাতের চাল আছে কিন্তু নেই প্রাকৃতিক সেই সুঘ্রাণ।
কৃষিবিদরা বলছেন, অন্যান্য জাতের সাথে পরাগায়ণের মাধ্যমে স্থানীয় জাত তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। অটোমেটিক মিলে পলিশের মাধ্যমে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ চালের উপরের অংশ অতিরিক্ত ছাঁটাই করা হয়। এসব কারণে সুগন্ধি নেই। ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোতেও পুরোপুরি ঘ্রাণ ও স্বাদ দিতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
চিকিৎসকরা বলছেন, খাদ্যে আর্টিফিশিয়াল উপকরণ মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না তারা। জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে দাবি তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিনিগুঁড়া বা চিনিআতপ, কালজিরা, বিন্নাফুল, কাটারিভোগ, বাদশাভোগ বেশ জনপ্রিয়। তবে এসব জাত এখন বিলুপ্ত প্রায়। রোগ-বালাই এর আক্রমণ ও ফলন কম হওয়ায় স্থানীয় জাত চাষে আগ্রহ নেই কৃষকের। এছাড়া, মাজরা ও কারেন্ট পোকার কারণে কৃষকরা প্রায় ৩০-৫০ ভাগ ফলন হারান। পারিবারিক চাহিদা বিবেচনায় স্থানীয় জাতের সুগন্ধি ধান আবাদ করেন কৃষকরা। এলাকার ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এ চালের পোলাও, বিরিয়ানি, পায়েস ইত্যাদি অনেক আগে থেকেই জনপ্রিয়। এসব খাবার বাদ দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন কিংবা অনুষ্ঠান যেন অপূর্ণ থেকে যায়। ঈদ, পূঁজা, বিয়ে, জন্মদিনসহ সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে চিনিআতপ চালের চাহিদা ব্যাপক। যে কোন বাসাবাড়িতে উৎসবে সুগন্ধি চাল ব্যবহার হতো। সুঘ্রাণ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ত। এ চালের দামও অনেক বেশি।
মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকায় এই চালের রয়েছে বিশাল বাজার। কৃষকদের প্রয়োজনে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) কয়েকটি উন্নত জান উদ্ভাবন করেছে। স্থানীয় জাতের চেয়ে এসব জাতের ফলন প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু এই জাতগুলোতেও তেমন ঘ্রাণ এবং স্বাদ নেই। বাজারে সুগন্ধি নামে নানা রকমের চাল থাকলেও তাতে নেই প্রাকৃতিক সুঘ্রাণ। যা আছে তার সবই কৃত্রিম রাসায়নিক ফ্লেভার। জাত যেটাই হোক না কেন মিনিকেট নাজির শাইলের মতো বাজারে ঢুকলেই হয়ে যাচ্ছে চিনিগুঁড়া!
এদিকে, বর্তমান স্থানীয় খুচরা বাজারে সবচেয়ে ভালোমানের সুগন্ধি চাল ১০০-১১০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এই একই চাল বস্তা থেকে কর্পোরেট মোড়কে প্যাকেজিং করে কেজিতে ৪০-৫০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকা কেজি দরে। সম্প্রতি জেলার মহাদেবপুর উপজেলার সরস্বতীপুর এলাকার এসিআই ফুডস লিমিটেড (রাইস ইউনিট) সুগন্ধি চালের প্যাকেটে অতিরিক্ত মূল্য লেখায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং জেলা খাদ্যবিভাগ।
অনুসন্ধান বলছে, উৎপাদন পর্যায়ে ও কৃষকের বাড়িতে স্থানীয় পদ্ধতিতে ভাঙ্গানো (পক্রিয়াজাত) চালে সুগন্ধি না থাকলেও চালকলের আশপাশে গেলেই নাকে সুগন্ধ আসে। এর রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে দেখা যায়, জেলার চালকলগুলোতে ভারতের জগন ইন্ডাস্ট্রিজ এর তৈরি বাসমতি পাউডার ফ্লেভার মিশ্রণের মাধ্যমে ঘ্রাণ যুক্ত করা হচ্ছে।
দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে নামে-বেনামে বিভিন্ন কোম্পানির পাউডার ও তরল রাসায়নিক কেমিক্যালের কৃত্রিম ফ্লেভার দেশে প্রবেশ করছে। চোরাকারবারিরা ভারত থেকে এসব সংগ্রহ করে পৌঁছে দিচ্ছে এ অঞ্চলের মিল মালিকদের কাছে। চাল প্রক্রিয়াজাত করার সময় প্রত্যেক মেট্রিক টনে ১-২ কেজি করে এ পাউডার অথবা তরল ভালোভাবে মিশিয়ে দিলে চলে আসে সুগন্ধ। এছাড়াও চম্পা কাটারি, কাটারি, মোয়াজ্জিম, পাইজাম ও অন্যান্য জাতের চাল অত্যাধুনিক মেশিনে পলিশের মাধ্যমে উপরের অংশ অতিরিক্ত ছাঁটাই করে নির্ধারিত সাইজে এনে সুগন্ধি ফ্লেভার মিশিয়ে বাজারে চিনিগুঁড়া নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এছাড়াও জেলার চালকলগুলোতে উৎপাদিত চাল ক্রয় করে তাদের কারখানায় মোড়কজাতের মাধ্যমে কেজিতে ৪০-৫০ টাকা বাড়িয়ে দুইটি কর্পোরেট কোম্পানি ভোক্তাদের পকেট থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলেও অনুসন্ধানে জানা গেছে।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আমন ও বোরো মৌসুমে সুগন্ধি জাতের ধান চাষাবাদ হয়। ২০২৪-২০২৫ আমন মৌসুমে জেলার ১১টি উপজেলায় ৫২ হাজার ৯৫ হেক্টর জমিতে সুগন্ধি জাতের ধানের চাষাবাদ হয়েছে। এরমধ্যে উচ্চফলনশীল (উফসী) ব্রিধান-৩৪, ব্রিধান-৭৫, গোল্ডেন আতব ৩১ হাজার ৯৯৫ হেক্টর এবং ২০ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের চিনিআতপ, বিন্নাফুল ও কালজিরা। এসব জমি থেকে ধান উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ২২ হাজার ২৭৫ মেট্রিক টন। বোরো মৌসুমে জেলায় ব্রিধান-৫০, ব্রিধান-৭৫, ব্রিধান-১০৪ ও গোল্ডেন আতপ জাতের ৫ হাজার ২০ হেক্টর জমি থেকে ১৯ হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে। ২০২৪-২০২৫ আমন ও বোরো মৌসুমে জেলায় উৎপাদিত সুগন্ধি জাতের মোট এক লাখ ৪২ হাজার ২২৫ মেট্রিক টন ধান থেকে চাল পাওয়া যাবে ৯৩ হাজার ৮৬৮ মেট্রিক টন।
জেলা খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় সুগন্ধি চাল উৎপাদনকারী ২৬টি চালকল রয়েছে। এরমধ্যে অটোমেটিক ২৪টি ও দুইটি সেমি অটোমেটিক। যার পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতা ১৪ হাজার ৯৪৮ দশমিক ০৬০ মেট্রিক টন। এসব চালকলে উৎপাদিত লাখ লাখ মেট্রিক টন চিনিগুঁড়া চাল স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে সরবরাহ করা হয়।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে মহাদেবপুর উপজেলার আখেড়া এলাকার আকিজ এসেনসিয়ালস এর কয়েকজন কর্মী জানান, এখন কোন জাতেই আর সুগন্ধি নেই। যা আছে তার সবই কৃত্রিম। ধান থেকে চাল প্রক্রিয়াজাত করার সময় বাসমতি পাউডার ফ্লেভার অথবা তরল মিশিয়ে প্যাকেজিং করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চালকল মালিক জানান, ভোক্তারা সুগন্ধি ছাড়া পোলাও এর চাল কিনতে চান না। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে কৃত্রিম কেমিক্যালের সুগন্ধি ফ্লেভার মেশাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার জানান, কৃত্রিম উপায়ে সুগন্ধি মেশানো হয় কিনা সেটা তিনি বলতে পারবেন না। ভোক্তারা দেখে শুনে ক্রয় করেন বলে দাবি তার।
জানতে চাইলে নওগাঁ বিএসটিআই আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক জহুরুল হক জানান, এসিআই ফুডস ও আকিজ এসেনসিয়ালস এর সুগন্ধি চাল মোড়কজাতের অনুমোদন রয়েছে। চালে কৃত্রিম ফ্লেভার মেশানোর সুযোগ নেই।
এবিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রুবেল আহমেদ জানান, প্যাকেটের গায়ে অতিরিক্ত দাম লেখার কারণে এসিআই ফুডস এর ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। আলাদাভাবে চালে সুগন্ধি ফ্লেভার মেশানোর বিষয়ে জানেন না। এ ব্যাপারে অভিযান পরিচালনা করবেন বলে জানান তিনি।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ফরহাদ খন্দকার জানান, অফিসিয়ালি চালে কৃত্রিম ফ্লেভার দেয়ার সুযোগ নেই। এটি ভোক্তাদের সাথে প্রতারণা। জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তিনি।
মুঠোফোনে রাজশাহীর ব্রি আঞ্চলিক কার্যালয়ের চীফ সাইন্টিফিক অফিসার ডক্টর মোহাম্মদ হোসেন জানান, ব্রিধান ৩৪ একদম অরিজিনাল পোলাও এর চাল। এটিতে সুগন্ধ রয়েছে। ব্রিধান ৯০ এর ফলন বেশি। কিন্তু এটার সমস্যা সুগন্ধ নেই। অসাধু ব্যবসায়ীরা এই চালে সেন্ট মেরে বাজারে দেয়। অটোরাইস মিল কম্পিউটারের প্রিন্টারের মত, যা প্রিন্ট চাইবেন করে দিবে বলেও জানান এই কৃষি বিজ্ঞানী।
কেকে/ আরআই