সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদাকে মব সৃষ্টি করে হেনস্তার ঘটনায় সরব রাজনীতিবিদরা। পাশাপাশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও মবের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও মবের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। তারা বলছেন, যত বড় অপরাধই হোক, মব জাস্টিস কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান তারা। এদিকে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও মবের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে।
গত রোববার সন্ধ্যার দিকে সাবেক সিইসি নুরুল হুদার উত্তরার বাসায় ‘মব’ তৈরি করা হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, নুরুল হুদা সাদা একটি টি-শার্ট ও লুঙ্গি পরা। তাকে ঘিরে রয়েছেন একদল লোক। তারা নুরুল হুদাকে একটি জুতার মালা পরিয়ে রেখেছেন। এক ব্যক্তিকে জুতা দিয়ে তাকে আঘাত করতেও দেখা যায়। পাশেই পুলিশ দাঁড়ানো ছিল। ভিডিওতে আরো দেখা যায়, কেউ কেউ নুরুল হুদার দিকে ডিম ছুড়ে মারছেন এবং নানাভাবে তাকে হেনস্তা করা হচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, হেনস্তার পর নুরুল হুদাকে পুলিশে দেওয়া হয়।
পরবর্তীকালে এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও তথ্য--উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পুলিশ ছয়জনকে শনাক্ত করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, কেএম নুরুল হুদাকে হেনস্তায় ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শেখ ফরিদ হোসেন নেতৃত্ব দিয়েছেন। শনাক্ত হওয়া সবাই ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
পুলিশ এ ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করেছে। মামলায় ফরিদসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদেরও আসামি করা হয়েছে। এর আগে গত সোমবার রাতে হানিফ মিয়া নামের একজনকে সেনাবাহিনী আটক করে উত্তরা পশ্চিম থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। তিনি উত্তরা পশ্চিম থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব। তাকে মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে গতকাল আদালতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ জানায়, মামলায় এজাহারনামীয় অন্য আসামিদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক দলের তুরাগ থানার সভাপতি দুলাল, উত্তরা পশ্চিম থানার আহ্বায়ক সেলিম, উত্তরা পূর্ব থানার যুগ্ম আহ্বায়ক কাইয়ুম এবং দলের কর্মী মুজাম্মেল হোসেন ঢালী। ভিডিওতে দেখা গেছে, নুরুল হুদাকে জুতা দিয়ে মারছিলেন মুজাম্মেল হোসেন ঢালী।
‘মব ভায়োলেন্স’ বন্ধ করা যাচ্ছে না, তবে কমিয়ে আনা হচ্ছে বলে দাবি করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ভবিষ্যতে মবের ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। নুরুল হুদার বিষয়টি উল্লেখ করে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ওই ঘটনায় আমরা সবাই দুঃখিত। এটা মেনে নেওয়া যায় না। ওই ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে। আরো কেউ জড়িত আছে কি না, খুঁজে দেখা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারো দুর্বলতা থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, কারো অপরাধ যত বড়ই হোক, মব জাস্টিস সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি আরো বলেন, গত তিনটি নির্বাচন ছিল শেখ হাসিনার একক নাটকীয় নির্বাচন। এসব নির্বাচনের সময়কার সব নির্বাচন কমিশনারই ফ্যাসিবাদের অংশ। তবে তারা যত বড় অপরাধীই হোক, বিচার হবে আইনের মাধ্যমেই, মব জাস্টিসের মাধ্যমে নয়। মব জাস্টিস সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করা। মব জাস্টিসের মতো অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধ করা। এ সময় মব জাস্টিসে দলের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। আদালতে পুলিশের উপস্থিতিতে কীভাবে আসামিরা হেনস্তা হন, এমন প্রশ্নও রাখেন রিজভী।
এর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ‘আমরা মব কালচারে বিশ্বাস করি না, আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে যাচ্ছি। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার গ্রেফতার প্রক্রিয়া এবং তার বিচার প্রক্রিয়ায় আইনগতভাবে যথাযথভাবে পরিচালিত হবে এটা আমরা প্রত্যাশা করি।’ তিনি আরো বলেন, ‘নুরুল হুদার ওপরে যে অবমাননাকর ব্যবহার করা হয়েছে এটা আমরা সমর্থন করি না। আমরা চাই, কোনো ব্যক্তি যত বড় অপরাধীই হোন না কেন তার আইনি এবং সাংবিধানিক অধিকার যেন ভোগ করার অধিকার অক্ষুণ্ন থাকে।’
এদিকে মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা গ্রহণযোগ্য নয় বলে উল্লেখ করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আমরা গভীর পরিতাপ ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, দেশে এক ধরনের মব তৈরি করে হামলা, অবমাননা, নির্যাতনের সংস্কৃতি চালু হচ্ছে। এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। অভ্যুত্থানের ১০ মাস অতিবাহিত হলেও এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর কোনো ভূমিকায় আমরা দেখতে পাইনি, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতি থাকলেও নিষ্ক্রিয় দেখা গেছে। মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের এই ব্যর্থতা গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু বিবৃতি দিয়ে দায় সারলে চলবে না অবশ্যই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘সম্প্রতি ১৮ সালের নৈশ নির্বাচনের হোতা নুরুল হুদাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে জুতার বাড়ি দেওয়া বা জুতার মালা গলায় পরানোর ঘটনা আমরা দেখলাম। বাংলাদেশে ১৪, ১৮ ও ২৪-এর প্রহসনের নির্বাচনের পেছনে যারা ছিলেন, তাদের প্রত্যেকেরই এসব নির্বাচনের ও গণতন্ত্র ধ্বংসের দায় আছে এবং তাদের সবাইকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু বিচারের আগেই তাদের মব সৃষ্টি করে হেনস্তা করার মাধ্যমে অপরাধীর বিমানবিকীকরণের যে উদাহরণ সৃষ্টি হচ্ছে তা মোটেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কোনো দৃষ্টান্ত নয়। অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা ন্যায়বিচার দেখতে চাই, বিচারের নামে কোনো প্রহসন কিংবা মব বিচার যাতে আর কোনোভাবেই চলতে না পারে, সে জন্য সরকারকে অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।’
মবের উদ্দেশ্য জনগণের মুখ বন্ধ করে রাখা বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন। তিনি বলেন, আইনের শাসনের কথা বলে আগে র্যাবের শাসন ছিল এখন সেটা মবের শাসনে রূপান্তরিত হয়েছে। দুটার উদ্দেশ্য কিন্তু এক। জনগণের মুখটাকে বন্ধ করে রাখা। তিনি আরো বলেন, ‘মবকে আমরা মুভমেন্টের অধিকারী হিসেবে দেখছি। তাতে করে হয় কি মুভমেন্টের যে নৈতিকতা থাকে সেটা নষ্ট হয়ে যায়। যদি একটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আমাদের গড়ে তুলতে হয় তাহলে মব সংস্কৃতির বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, মব জাস্টিসকে আমরা কখনোই অনুমোদন করি না। এর আগেও অনেক ঘটনায় আমরা ছিনতাই ও ডাকাতির মামলা করেছি। এমনকি পুলিশের অবহেলার কারণে কিছু কর্মকর্তাকেও সাসপেন্ড ও শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, তিন-চার মাস আগের তুলনায় এখন মব জাস্টিসের ঘটনা অনেক কম।
৩০ নাগরিকের বিবৃতি
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্তর্বর্তী সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় দেশে আইনের শাসনপ্রতিষ্ঠা এবং সব মানুষের মানবাধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকার প্রতিনিয়ত উদ্বেগজনকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ৩০ জন নাগরিক। তারা বলেছেন, ৮ থেকে ১০ মাস ধরেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও এলাকায় মব ভায়োলেন্স বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতার ঘটনা ঘটে চলেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত প্রায় অনুপস্থিত। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাসহ যথাযথ আইনানুগ পন্থা অবলম্বন করা হলে হয়তো একটার পর একটা মব সহিংসতার ঘটনা ঘটত না।
গতকাল গণমাধ্যমে যৌথ বিবৃতি পাঠিয়েছেন ওই ৩০ জন নাগরিক। বিবৃতিতে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদাকে মব ভায়োলেন্সের (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতা) দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার নিন্দা এবং এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত শনাক্ত করে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি নুরুল হুদার বিরুদ্ধে অভিযোগেরও সুষ্ঠু তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহিসহ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন ওই নাগরিকেরা।
বিবৃতিতে বলা হয়, মবের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত প্রায় অনুপস্থিত। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাসহ যথাযথ আইনানুগ পন্থা অবলম্বন করা হলে হয়তো একটার পর একটা মব সহিংসতার ঘটনা ঘটত না। বেশিরভাগ মব সহিংসতার সঙ্গে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত আক্রোশ ছাড়াও কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের অনুসারীদের সম্পৃক্ততা থাকে। বড় ও প্রভাবশালী দলগুলোসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীল নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এমন অমানবিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার ও বলিষ্ঠ ভূমিকা মানুষের প্রত্যাশা থাকলেও তারা সেই ভূমিকা না নেওয়ায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। মব জাস্টিসের নামে মব সহিংসতা চালিয়ে কাউকে অসম্মানিত, ব্যক্তিগতভাবে অপমান করা জননিরাপত্তার জন্য হুমকিই শুধু নয়, তা একই সঙ্গে বিশ্বজনীনভাবে নাগরিক অধিকারের চরম লঙ্ঘন।
কেকে/এআর