প্রকৌশলী পেশাজীবীদের শীর্ষ সংগঠন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি)-তে নির্বাচন সংক্রান্ত ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি জেনারেল মিটিং’ (ইওজিএম) ঘিরে চরম উত্তেজনা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
শনিবার (১০ মে) দুপুরে রাজধানীর রমনায় অবস্থিত আইইবি চত্বরে সংঘর্ষ, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে পুলিশ ও দুই পক্ষের প্রকৌশলী মিলিয়ে আহত হন অন্তত ২৫ জন। গ্রেফতার করা হয়েছে একজন প্রকৌশলীকে, যিনি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক ছাত্রদল নেতা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের বর্ণনা অনুযায়ী, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি)-তে সংঘর্ষের শুরু হয় অনুমতি-সংক্রান্ত জটিলতা ও দ্বন্দ্ব থেকে। আগে থেকেই ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি জেনারেল মিটিং’ (ইওজিএম) আয়োজনের অনুমতি নিয়েছিল প্রকৌশলীদের একটি গ্রুপ। নির্ধারিত সময়ে তারা অনুষ্ঠান শুরু করলে, অপর একটি গ্রুপ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চত্বরে প্রবেশের চেষ্টা করে। তবে একই স্থানে পৃথকভাবে সভা আয়োজনের অনুমতি না থাকায় পুলিশ তাদের প্রবেশে বাধা দেয়।
এ বাধা থেকেই শুরু হয় বাকবিতণ্ডা, যা দ্রুতই উত্তপ্ত সংঘর্ষে রূপ নেয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়েন বিক্ষুব্ধ প্রকৌশলীরা। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পুলিশও লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। বাইরে থাকা প্রকৌশলীদের কেউ কেউ এজিএমে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের টার্গেট করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে বিস্ফোরিত হয় বেশ কিছু ককটেল, যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে।
চরম উত্তেজনার মধ্যে পুলিশ অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করে বাইরে অবস্থান নেওয়া প্রকৌশলীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে বিক্ষুব্ধ প্রকৌশলীরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। ঘটনাটি পেশাজীবী সংগঠনের ভেতর ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক প্রভাব ও বিভক্তির একটি স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ধানমন্ডি জোনের এসি শাহ মোস্তফা তারিকুজ্জামান বলেন, ‘এজিএম চলাকালে অতর্কিত হামলায় পুলিশসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছে। পরবর্তীতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করা হয়।’
শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মনসুর বলেন, ‘তাদের অতর্কিত হামলায় আমরা ৫-৬ জন আহত হয়েছি। আমার বুকে একাধিক ইট লেগেছে। তবে পুলিশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছে।’
সংঘর্ষের পর বিকাল ৩টায় আইইবি’র প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলামের (রিজু) সভাপতিত্বে আইইবি অডিটরিয়ামে ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি জেনারেল মিটিং’ (ইওজিএম) শুরু হয়। সেখানে সাধারণ ইঞ্জিনিয়াররা নির্বাচন ও হামলার বিষয়ে তাদের বক্তব্য দেন।
প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির প্রধান দায়িত্ব হলো একটি স্বচ্ছ, পরিশুদ্ধ ভোটার তালিকা প্রস্তুত করে আইইবি’র গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। তিনি জানান, আগামী ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের জন্য তারা দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং সেই লক্ষ্যেই ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি জেনারেল মিটিং’ (ইওজিএম) আহ্বান করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘ইওজিএম ঘিরে স্বৈরাচারী শক্তির দোসররা ইচ্ছাকৃতভাবে এ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সৃষ্টি করেছে। তারা বহিরাগতদের দিয়ে আমাদের সদস্যদের ওপর সরাসরি হামলা চালিয়েছে।’ এ সময় তিনি উল্লেখ করেন, পুলিশ সদস্যরা জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন এজন্য তিনি পুলিশকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
এদিকে, ঘটনার পর ইওজিএম-এর অংশ নেওয়া সাধারণ প্রকৌশলীরা দাবি জানিয়েছেন যারা এ সহিংসতায় সাধারণ সদস্যদের রক্তাক্ত করেছে, তাদের আইইবি থেকে কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে, সদস্যপদ স্থগিত করতে হবে এবং আগামী নির্বাচনে তাদের প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা বাতিল করতে হবে।
আইইবি’র প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলামের (রিজু) সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন আইইবি’র ভাইস-প্রেসিডেন্ট, প্রকৌশলী খান মনজুর মোরশেদ, প্রকৌশলী শেখ আল আমিন, প্রকৌশলী নিয়াজ উদ্দিন ভূইয়া, প্রকৌশলী এ. টি. এম. তানবীর-উল-হাসান (তমাল), সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. প্রকৌশলী মো. সাব্বির মোস্তফা খান, সহকারী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাহবুব আলম, প্রকৌশলী মো. নূর আমিন, প্রকৌশলী সাব্বির আহমেদ ওসমানী, প্রকৌশলী মুহাম্মদ আহসানুল রাসেল।
অন্যদিকে এ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নিজেদের বিএনপি-সমর্থিত প্রকৌশলী দাবি করে নির্বাচন বিষয়ে ইওজিএম ডাকার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অপর একটি গ্রুপ। তারা অভিযোগ করেন, গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে বর্তমান ‘অবৈধ দখলদার’ কমিটি এ সভার আয়োজন করেছে। তারা জানান, সভাস্থলে প্রবেশে বাধা দেওয়া এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশের লাঠিচার্জ ও দমন-পীড়ন ছিল সরকারের প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণার পরিপন্থী।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ প্রকৌশলীরা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে বক্তব্য রাখেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও আইইবির সাবেক প্রেসিডেন্ট আ ন হ আখতার হোসেন, যিনি পুলিশি সহিংসতার নিন্দা জানান এবং অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার দাবি তোলেন।
আ ন হ আখতার হোসেন বলেন, ‘আইইবিতে এর আগে শেখ হাসিনার আমলে যারা দায়িত্বে ছিলেন, তারা প্রতিষ্ঠানটিকে টেন্ডারবাজি, টেন্ডার বাণিজ্য ও বদলি বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিলেন। এখন যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছে, তারাও যদি একই কাজ করে, তাহলে আগেরদের সঙ্গে তাদের উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আইইবির সদস্যদের নিজ প্রতিষ্ঠান চত্বরে ঢোকার অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। অথচ পুলিশ আমাদের সদস্যদের প্রবেশে বাধা দিয়েছে। তারা জামায়াত-শিবিরের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের প্রকৌশলীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এতে আমাদের প্রায় ১০ জন সদস্য আহত হয়েছেন।’
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনার জন্য এ ধরনের ইওজিএম ডাকা গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন। আইইবি’র গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির। কিন্তু বর্তমান ‘অবৈধভাবে দখলকারী’ প্রশাসন গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে এ সভার আয়োজন করেছে।
বিক্ষুব্ধ প্রকৌশলীরা দাবি করেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সভাস্থলে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে। এ সময় বহিরাগতরা তাদের ওপর ককটেল নিক্ষেপ করে বলে তারা দাবি করেন। এতে কয়েকজন প্রকৌশলী আহত হন এবং একজনকে গ্রেফতার করা হয়, যিনি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক ছাত্রদল নেতা ও প্রথম নির্বাচিত ভিপি ছিলেন।
প্রকৌশলীরা জানান, সংঘর্ষ এড়াতে তারা স্থান ত্যাগ করেন। তবে এ ঘটনায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনের পর গঠিত সরকারের পক্ষ থেকে মতপ্রকাশ ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। আজকের পুলিশের আচরণ ছিল স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ বাহিনীর মতো।’
প্রকৌশলীদের দাবি, তারা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করে সভার নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। তবু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা দিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আইইবির সাবেক প্রেসিডেন্ট, সম্মানী সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় নির্বাহী কমিটি ও কাউন্সিলের সদস্যরাও ছিলেন। তারা অভিযোগ করেন, তাদের একটি সংগঠিত মহল রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খালেদ হাসান চৌধুরী (পাহিন), আইইবি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়া মো. কাইউম, বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জি. এম এম গালিব, আইইবি’র সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুর রউফ, এক্স-জেসিডি ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের আহ্বায়ক ও অ্যাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যসচিব প্রকৌশলী শোয়েব বাশরী হাবলু, বুয়েট ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মো. গোলাম মোস্তাফা, কুয়েট ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস মো. তারেকুজ্জামান শাহিনসহ ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশ।
কেকে/ এমএস