চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীদের জন্য নির্ধারিত ওয়ার্ডগুলো যেন একেকটি ‘আর্থ-সামাজিক শ্রেণি’র প্রতিচ্ছবি। টাকা, রাজনৈতিক প্রভাব বা সন্ত্রাসী পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে বন্দীদের ভাগ করে দেওয়া হয় বিভিন্ন ওয়ার্ডে। এখানে কারও কক্ষ হবে আরামদায়ক, কারও জন্য বরাদ্দ হবে গাদাগাদি করে রাত কাটানোর এক টুকরো স্থান। এখানে নতুন এক ধরনের বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। যাকে বলা হয় ‘ওয়ার্ড বাণিজ্য’। ভালো ওয়ার্ডে থাকার জন্য প্রতিমাসে দিতে হয় নির্ধারিত অঙ্কের টাকা। যেসব ওয়ার্ডে একটু স্বস্তি আছে, ফ্যান সচল আছে, আলো-বাতাস চলাচল আছে সেখানে স্থান পেতে হলে লাগে আর্থিক সামর্থ্য কিংবা প্রভাবশালী পরিচয়।
সদ্য জামিনে মুক্তি পাওয়া কয়েকজন বন্দী জানান, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ‘সাক্ষাৎ’ এখন আর শুধু পরিবারের সঙ্গে দেখা করার অধিকার নয়, এটি এক ধরনের ব্যবসা। সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে বন্দীরা স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পান, তবে এই সাক্ষাৎ নির্ভর করে টাকা ও প্রভাবের ওপর। নিয়ম অনুযায়ী বন্দীর স্বজনরা কারা ফটকে গিয়ে আবেদনপত্র জমা দেন, নির্ধারিত সময়ে সাক্ষাৎ সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সাধারণ বন্দীদের স্বজনরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন ফটকে। অনেক সময় তাদের সাক্ষাৎ হয়ই না। আবার কেউ যদি ‘নির্ধারিত ঘুষ’ প্রদান করেন, তখনই মিলছে দ্রুত সাক্ষাতের সুযোগ, এমনকি নিয়ম বহির্ভূত সময়েও। এমনকি টাকার বিনিময়ে মিলছে সরাসরি সাক্ষাৎ। এজন্য অবশ্যই দিতে হয় নির্ধারিত হারে অর্থ।
শুধু সাক্ষাৎ নয়, বন্দীদের জন্য বাইরে থেকে খাবার আনা, ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, জামাকাপড় পাঠানো সবকিছুতেই ঘুষ দিতে হয়। এই ঘুষের হার নির্ধারিত। কী ধরনের খাবার, কতজনের জন্য, কোন ওয়ার্ডে পাঠানো হবে তার ওপর নির্ভর করে ঘুষের অঙ্ক।
নজরুল ইসলাম নামে সদ্য কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দী জানান, চট্টগ্রাম কারাগারের ভেতরে যমুনা-৮ নম্বর ওয়ার্ডকে অঘোষিত আওয়ামী লীগের অফিস বানিয়ে রেখেছে। এ ওয়ার্ডে বন্দী হিসেবে রয়েছে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইউনুস, রাংগুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন চৌধুরী মিল্টন, ফটিকছড়ি উপজেলার আওয়ামী লীগ সমর্থিত দুইজন চেয়ারম্যান এবং একই সঙ্গে আছেন পটিয়া উপজেলার কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তারা কারাগারে বসে চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করার অভিযোগ আছে।
একজন সাবেক বন্দী জানান, যদি আপনি সাধারণ বন্দী হন, তাহলে আপনাকে রাখা হবে টয়লেটের পাশের স্যাঁতসেঁতে কক্ষে। কিন্তু আপনি যদি টাকা খরচ করতে পারেন বা আপনার কোনো রাজনৈতিক ব্যাকআপ থাকে, তাহলে আপনার জায়গা হবে বিশেষ ওয়ার্ডে। কারাগারের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ ও গোষ্ঠীর মধ্যে চলে ক্ষমতার রাজনীতি। কিছু প্রভাবশালী সন্ত্রাসী, যারা বাইরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তারা ভেতরেও তৈরি করেছেন প্রভাববলয়। এই গ্রুপগুলোর সদস্যদের আছে আলাদা কক্ষ, মোবাইল ফোন, দেহরক্ষীসদৃশ অন্য বন্দী এবং ‘ফেরিওয়ালা’ যারা তাদের চাহিদামতো সবকিছু জোগাড় করে দেয়।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বন্দীদের মধ্যে গড়ে উঠেছে গোষ্ঠীগত আধিপত্য। কেউ আওয়ামী লীগপন্থী, কেউ বিএনপি ঘনিষ্ঠ এভাবেই ওয়ার্ড ভাগ হয় ‘পলিটিক্যাল লাইন’ অনুযায়ী। একটি ওয়ার্ডে একজন ‘ওয়ার্ড মাস্টার’ থাকে, যিনি মূলত ওয়ার্ডের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। কে কোথায় ঘুমাবে, কে কার সঙ্গে বসবে, কারা বাইরে থেকে খাবার আনতে পারবে এসব সিদ্ধান্ত তিনিই নেন। ওয়ার্ড মাস্টার হওয়াও এখন একটি লাভজনক ‘পদ’। যার পেছনে থাকে কারা কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ অনুমোদন এবং বিনিময়ে নিয়মিত আর্থিক লেনদেন। কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই ক্ষমতাবান বন্দীদের রয়েছে গোপন বোঝাপড়া। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলেও ব্যবস্থা হয় না। বরং তারা আরও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।কারা কর্তৃপক্ষের
একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমরা চাই বা না চাই কিছু বন্দী এতই শক্তিশালী যে তাদের কিছু বলা যায় না। বাইরের রাজনৈতিক ক্ষমতা বা অতীত পরিচয়ের কারণে তারা দাপটের সঙ্গে চলে। কর্তৃপক্ষও অনেক সময় নিরুপায়। মেটাতে হয় তাদের নানা আবদার। এ পরিস্থিতির শিকার হয় সাধারণ বন্দীরা। তাদের ঘর নেই, নিরাপত্তা নেই, এমনকি অনেক সময় শারীরিক নিপীড়নেরও শিকার হতে হয়।
একাধিক সূত্র জানায়, ওয়ার্ড মাস্টারদের অনুগত না হলে সাধারণ বন্দীদের ওপর চলে চাপ। কখনও কারাগারে কাজ করতে বাধ্য করা হয়, কখনও নির্যাতন করা হয়।
অন্যদিকে, কারাগারে কিছু ‘ভিআইপি বন্দী’ রয়েছেন, যাদের জন্য যেন অন্য এক বাস্তবতা। এই বন্দীদের জন্য রয়েছে আলাদা কক্ষ, উন্নতমানের বিছানা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, এবং কখনও কখনও ‘কারা হাসপাতালে’ নিরবচ্ছিন্ন আরামদায়ক থাকা। কিছু বন্দীর জন্য কারা হাসপাতাল হয়ে উঠেছে পাঁচতারকা হোটেলের মতো। তাদের খাবার আসে বাইরের রেস্টুরেন্ট থেকে। মোবাইল ব্যবহারের সুযোগও রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিভিন্ন অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ভিআইপি সুবিধার বিনিময়ে প্রতি মাসে লাখ টাকারও বেশি লেনদেন হয়। কারা হাসপাতালের ‘বিছানা ভাড়া’ থেকে শুরু করে মোবাইল ব্যবহারের জন্য চার্জ, সাক্ষাতের বিশেষ সুযোগ— সবই চলে নির্দিষ্ট দালালদের মাধ্যমে।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. ইকবাল হোসেন বলেন, কারাগারে বন্দীদের নানাভাবে হয়রানি করে অর্থ আদায়ের বিষয়টি আমার জানা নেই। এরপরও এসব বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কেকে/এজে