শারিরিক অবস্থার কারণে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ব্যাপারে অনেকটা অক্ষম বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দলের ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসিত। ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তার দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা পুরোপুরি কাটেনি। জ্যেষ্ঠ নেতারাও আন্দোলনের মাঠে ততটা সফল নন। ফলে নজর এখন খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ এবং তারেক রহমানের সহধর্মীনি ডা. জুবাইদা রহমানের দিকে। সব কিছু ঠিক থাকলে বিএনপির রাজনীতিতে নতুন চমক হতে যাচ্ছেন সকল বিতর্কের উর্ধ্বে থাকা এই নারী।
বিগত ১৭ বছর ‘ক্লিন ইমেজের’ হিসেবে খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের বিকল্প হিসেবে জুবাইদা রহমান দলের হাল ধরবেন কি-না তা নিয়ে চর্চা কম হয়নি। তবে এ বিষয়ে জিয়া পরিবারের পক্ষ থেকে কখনো কিছু স্পষ্ট করে বলা হয়নি। তবে এবার খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেলে অনেক দিন পর আবার সামনে আসেন জুবাইদা। সব সময় তাকে শাশুড়ির সঙ্গে দেখা গেছে। বাসায়ও শাশুড়িকে সেবা করেছেন। দেশে ফেরার সময়ও তিনি খালেদার সঙ্গে থাকবেন। তার প্রত্যাবর্তন ঘিরে দেশের রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে নানা গুঞ্জন। লন্ডন বিএিনপির পক্ষ থেকে এটিকে পারিবারিক সফর বলা হয়েও পর্যবেক্ষকদের ধারণাÑ এটি হতে পারে বিএনপির রাজনীতিতে মোড়ের সুচনা। এদিকে ডা. জুবাইদা রহমান বেশ কিছুদিন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঢাকায় থাকবেন বলে জানিয়েছে দলীয় একটি সূত্র।
বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, দলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বিশ্বাসযোগ্য ও শিক্ষিত নেতৃত্বের ওপর। জুবাইদা রহমান সে জায়গায় স্বতন্ত্র। লন্ডনে থেকেও দলের জন্য এটা তার অনুপস্থিত নয়, বরং এক ধরনের রাজনৈতিক প্রস্তুতি। দলীয় কর্মীদের একটি অংশ মনে করছে, জুবাইদা রহমানের নেতৃত্বে এক ধরনের সৌম্য, শালীন ও উচ্চশিক্ষিত প্রোফাইল তৈরি হতে পারে, যা বিএনপিকে আধুনিক প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।
কেউ কেউ মনে করেন, পরিচ্ছন্ন ইমেজের এই নারী যদি এগিয়ে আসেন, তবে সেটি হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। অদূর ভবিষ্যতে যদি বিএনপির নেতৃত্বে জুবাইদা রহমানকে দেখা যায়, তবে সেটি হবে কেবল এক পরিবারের জয় নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের এক নতুন অধ্যায়। রাজনীতির ইতিহাসে আমরা বহুবার দেখেছিÑপরিবারের দায়িত্বশীল নারীরাই সংকটকালে নেতৃত্ব দিয়েছেন, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। খালেদা জিয়াও এর বড় প্রমাণ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘খালেদা জিয়া ফিরবেন, সঙ্গে তাদের দুই পুত্রবধূ ফিরবেন। তাদের নিরাপত্তা কেমন হবে তা নিয়ে আমাদের সিকিউরিটি মিটিং হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে একটা বড় রিসিপশনের চেষ্টা করছি। তাদের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আপাতত এটুকুই। পরে কী হবে সেটি জানতে পারবেন।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘দলীয় রাজনীতিতে ডা. জুবাইদা রহমানের সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এটা তাদের পারিবারিক সিদ্ধান্তের বিষয়। খালেদা জিয়ারও রাজনীতিতে আসার কথা ছিল না। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতিতে তিনি দল ও দেশের হাল ধরেছেন। বাংলাদেশ এখনো তো তাই নেতৃত্বশূন্যতা। এই পরিস্থিতিতে ওনারা যদি পারিবারিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এগিয়ে আসেন তাহলে নেতাকর্মীরা আনন্দিত হবেন। বিষয়টি জানার জন্য কর্মীদের অধীর আগ্রহ রয়েছে।’
আমার বাংলাদেশ-এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘বিএনপি যে ধরনের দল তাতে ডা. জুবাইদা রহমান আনুষ্ঠনিকভাবে রাজনীতিতে যুক্ত না হলেও তিনি প্রাসঙ্গিক এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিগণিত হবেন বলে আমি মনে করি। এছাড়া ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিচিতির কারণে ডা. জুবাইদা রহমানের এমনিতেই একটা ইতিবাচক ইমেজ রয়েছে। আমার মনে হয় বিএনপিতে কোনো কারণে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হলে তারা সেটা পূরণ করতে সক্ষম হবেন।’
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আদনান পাভেল বলেন, আমরা জানি বিগত সময়ে উনি (জুবাইদা রহমান) নানা রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতায় দেশে ফেরত যেতে পারছিলেন না। আমি মনে করি এটা বাংলাদেশের পলিটিক্সের জন্য একটা অন্ধকার যুগ।
লন্ডনের নিউহ্যাম কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি স্পিকার ব্যারিস্টার নাজির আহমেদ বলেন, তিনি যদি পলিটিক্সে ইনভলভ হতে চান- আমি মনে করি সেটা পজেটিভ দিক। এবং তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের বৃহৎ একটি দলের অ্যাক্টিং চেয়ারম্যানের সহধর্মীনি।
তবে জুবাইদা রহমানের এবারের সফরের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই বলে জানান যুক্তরাজ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পারভেজ মল্লিক। তিনি বলেন, তিনি সরাসরি যখন রাজনীতিতে আসবেন সেটা উনাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত। তবে এই মুহূর্তে আমরা সে রকম কোনো লক্ষণ দেখছি না।
এদিকে জুবাইদা রহমান দেশে ফেরার পর তারা নিরাপত্তা বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। জুবাইদা রহমান তার ধানমণ্ডির বাসায় থাকবেন বলে জানা গেছে।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষা ছুটি নিয়ে লন্ডনে যান জুবাইদা রহমান। দ্বিতীয় দফা সময় বাড়িয়েও পেশায় চিকিৎসক জুবাইদা দেশে ফিরে কাজে যোগ না দেওয়ায় বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যদিও বিএনপির বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ আছে। দীর্ঘ ১৭ বছর পর তিনি দেশে ফিরছেন। সিলেটের একটি রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা জুবাইদাকে নিয়ে এবার বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
তার বাবা প্রয়াত রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী সম্পর্কে জুবাইদা রহমানের চাচা। তবে জুবাইদা রহমান রাজনীতি সচেতন হলেও এখনো সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। বিভিন্ন সময় বাবা মাহবুব আলীর মৃত্যুবার্ষিকী ও জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের দু-একটি প্রোগ্রাম ছাড়া তাকে প্রকাশ্যে দেখা গেছে খুব কম।
মূলত ৯০ দশক থেকেই বিএনপি নারী নেতৃত্বে নির্ভরশীল। খালেদা জিয়া তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। এখনো দলের চেয়ারপারসন। তারেক রহমান এখনো ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তার দেশে ফেরার বিষয়ে আলোচনা চললেও স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি বলেই মনে করছেন অনেকে।
কেকে/এজে