চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মোতালেব বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন। ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, হত্যাচেষ্টা, অর্থপাচার, আন্দোলন দমনে অর্থ সহায়তা ও বিভিন্ন অভিযোগ ঝুলছে তার বিরুদ্ধে। ৫ আগস্টের পর তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা দায়ের হলেও এখনো তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মোতালেব রাজনীতিকে নিজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে সংসদ সদস্য পর্যন্ত দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তার সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে বহুগুণে। খাদ্য পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বনফুল এন্ড কোম্পানি এবং কিষোয়ান এন্ড কোম্পানির মালিক এই সাবেক সংসদ সদস্যের নাম বিভিন্ন সময় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছে। গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে তার বিরুদ্ধে সরাসরি হামলায় অর্থ ও সাংগঠনিক সহায়তার অভিযোগ ওঠে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্টের পর থেকে সাতকানিয়া বা লোহাগাড়া উপজেলায় তার উপস্থিতি আর লক্ষ্য করা যায়নি। বিভিন্ন মামলার পর পুলিশ তাকে খুঁজছে বলে দাবি করলেও এখনো পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। পুলিশ বলছে, তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আবদুল মোতালেবের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা তদন্তাধীন। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, আবদুল মোতালেব বিদেশে নয়; দেশেই অবস্থান করছেন। তবে তার প্রভাব, সম্পদ ও রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে স্পর্শ করতে পারছে না।
সাতকানিয়া উপজেলার বাসিন্দা নুরুল আবছার বলেন, ‘মোতালেব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি নিজেকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে আড়াল করার চেষ্টা করলেও বাস্তবে তিনি ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের ছায়াসঙ্গী।’
লোহাগাড়া উপজেলার বাসিন্দা আহমেদ মুসা নামে আরেকজন বলেন, ‘লোকমুখে শোনা যায়, তিনি সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। কিন্তু এসব অভিযোগের বিগত সময়ে কোনো কার্যকর তদন্ত হয়নি। বর্তমানেও তদন্তে অগ্রগতি নেই।’
এদিকে, ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট চট্টগ্রাম চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাজী সহিদুল ইসলামের আদালতে উত্তর জেলা যুবদলের দপ্তর সম্পাদক নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে আবদুল মোতালেবসহ ৪২০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আমিন নামের এক ব্যক্তি ২১৯ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন, যেখানেও আবদুল মোতালেব অন্যতম আসামি। পরবর্তীতে ১০ ডিসেম্বর ফারুকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি লোহাগাড়া থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন। এতে ২৪৮ জনকে আসামি করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টার দিকে উপজেলা পরিষদের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয়। এতে অনেকেই আহত হন এবং আহতদের হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে বাধা দেওয়া হয়। এসব মামলার অধিকাংশে আবদুল মোতালেবের নাম সরাসরি উল্লেখ রয়েছে। তবে পুলিশের ভাষ্য, তার অবস্থান শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
লোহাগাড়া থানার ওসি আরিফুর রহমান বলেন, ‘সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল মোতালেবের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে। তার অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন এবং জয়লাভ করেন। তবে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর তার বিরুদ্ধে একে একে বের হয়ে আসে পুরনো সব অভিযোগ।
সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার সাধারণ মানুষ দাবি, আবদুল মোতালেবের বিরুদ্ধে সব মামলা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। গেল ১৭ বছর আবদুল মোতালেবসহ যারাই সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলার বাসিন্দাদের জিম্মি করে নিজেদের আখের গুছিয়েছে, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়।
কেকে/এজে