ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

চাপাবাজ

নাহিদ হাসান রবিন
🕐 ৫:০০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ০৭, ২০২২

চাপাবাজ

রায়হান কবীর আমার বন্ধুর অফিসের কর্মচারী। মাঝে মাঝে বন্ধুর অফিসে যাওয়ার সুবাদে ওকে চিনি। পরিচয়ের পর থেকেই ওর পরিবারের অনেক সুনাম শুনে আসছি। অবশ্য ওর নিজ মুখে। কোনো কথার মাঝে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বেচারা একবার ওর পরিবারের কথা তুলবেই। দাদা এলাকার অনেক নামকরা লোক ছিলেন।

বাপ-চাচারাও দাদার নাম ধরে রাখতে পেরেছেন। এমনকি তার পরিবারের অন্য সবাইও সামাজিকভাবে অনেক ভালো অবস্থানে আছেন। ওদের অনেক জায়গা জমি ছিল। যমুনার ভাঙনে সব জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। আজ যদি সেই সব জমি থাকত তাহলে কি আর ওকে এই চাকরি করতে হতো! ওদের বড় কোনো কোম্পানি থাকত। সেখানে এলাকার লোকজন চাকরি করত। কপাল দোষে আজ এই অফিসে এই ছোট চাকরি করছে। তবে পরিবারের অন্যরা সবাই ভালো চাকরি করে। শহরে থাকে। কেউ কেউ ঢাকা শহরে নিজেদের ফ্ল্যাট করেছে। এসব নানান কথা নিজ থেকে বলে বেড়ায়। বোঝাতে চায়, নিজে ছোট চাকরি করলেও, পারিবারিক মর্যাদা কম নয়, সম্ভ্রান্ত পরিবার তাদের। সোজা কথা, এসব কথা বলে কিছুটা সম্মান পেতে চায়, কিছুটা সুবিধাও করে নিতে চায়। পুরাতনদের অনেকে বিষয়টা বিরক্তির চোখে দেখলেও, সামনাসামনি কিছু বলেন না, ভদ্রতা দেখিয়ে কৌশলে এড়িয়ে যান। রায়হান দীর্ঘদিন এই অফিসে চাকরি করে। নিজের প্রয়োজনে সবার সঙ্গে মিশলেও, মন থেকে অফিসের কারও প্রতি বিশ^াস রাখতে পারে না। নিজের ভেতরটা কালো হওয়ায়, অন্যদেরও তেমন ভাবে। এটা অফিসের সবাই জানে। ওর সঙ্গে সবাই এজন্য প্রয়োজন ছাড়া কথাবর্তা বলেন না। অফিসের তৃতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারী হয়ে ভাব ধরতে চায় অফিসারের মতো। ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম। রায়হানের বেলাতেও এমনটি হয়েছে। কিছুদিন হলো রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা করে। সহকর্মীদের সঙ্গে সুযোগ মতো রাজনীতির দাপট দেখানোর চেষ্টাও করে। অফিসের সবাই অন্য জেলার লোক হওয়ায়, তাকে কিছুটা ডরও করে।

বছরখানেক হলো রায়হান সুদের কারবার করে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে চাকরি করে। বেশ কিছু অবৈধ টাকা কামাই করেছে। চেক বন্ধক রেখে এখন মোটা সুদে টাকা দেয়। ওর টাকা দেওয়ার ধরনটা অবশ্য একটু আলাদা। কেউ টাকা চাইলে বলে- ভাই আমার তো টাকা না, একজন আছে, যে টাকা দেয়। কিন্তু সরাসরি আপনাকে দেবে না। পরিচিত কেউ বললে, আমি তার কাছ থেকে নিয়ে দিই। এমন কৌশলে রায়হান সুদের কারবার করে। ইদানীং বেশ টাকার গরমও দেখা যায়। পোশাকেও ঢের পরিবর্তন। প্রায়ই নতুন পোশাক পরে অফিসে আসে। তার নতুন পোশাক নিয়ে অফিসের কেউ যদি কোনো কথা না বলে, তখন স্বভাবগত কারণেই কথার ফাঁকে নিজে থেকেই বলে- শার্ট বা প্যান্টটা কেমন হয়েছে দেখেন তো। একটু দাম দিয়েই কিনলাম। আসলে পোশাক ভালো না হলে হয় না, কী বলেন। দুটো টাকার মুখ দেখলে যা হয় আর কী। কথায় বলে সুদের টাকা নাকি বাতাসের আগে দৌড়ায়। রায়হানেরও তেমনি হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারী, খেয়ে-পরে চলা যেখানে দায়, সেখানে উপজেলা শহরে কয়েক শতক জায়গা কিনেছে। আবার সুদের ওপর লাগানো আছে কয়েক লাখ টাকা। এখন রায়হানের সাহেবি ভাব। অফিসের অন্যান্য লোকজন অফিস শেষে বাসায় যাওয়ার সময় বাজার করে, রায়হান অফিসে আসার সময় মোটা বাজার করে অফিসের লোকজনকে দেখানোর জন্য।

হোটেলে বসলে রায়হান এখন ওয়েটারদের তুই-তোরাকি সম্বোধন করে। রিকশাওয়ালাদেরও তাই। তবে, দুটো টাকা হলেও, স্বভাব বদলায়নি এখনো। কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায় না। এই শহরের এমন কোনো চায়ের দোকানদার নেই তার কাছে পঞ্চাশ-একশ’ টাকা পাবে না। বাসা থেকে রিকশায় উঠে অফিসের একটু ফাঁকে চায়ের দোকানের সামনে নামে। প্রতিদিনই কৌশলে কোনো না কোনো লোকের কাছ থেকে রিকশা ভাড়া আর দু-একটা সিগারেট কিনে নেয়। এই কারণে তাকে দেখলে অনেকেই না দেখার ভান করে বা সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শহর বলে কথা। দু-চারজন সরে গেলেও, লোকের অভাব নেই। তার ওপর চাকরি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে। কাজেই চেয়ারম্যান, মেম্বার আর ঠিকাদারদের সঙ্গে পরিচয়। তাদের কেউ না কেউ এ সময় চায়ের দোকানে থাকেই। তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার আচরণ মেনে নেন। কারণ ওই অফিসে তাদের অনেক কাজ। স্বার্থের জন্যই মেনে নিতে হয়।

অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকও ছোট চাকরি করে। রায়হান হয়তো তেমনই একজন। এমনটাই ভেবেছিলাম। সেই ভাবনা উল্টে গেল এক সময়। একবার রায়হানের সম্ভ্রান্ত পরিবার দেখার সুযোগ হলো। ওর ছোট বোনের বিয়েতে অফিসের স্টাফদের সঙ্গে আমাকেও দাওয়াত করেছিল। আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে না থাকলেও, বন্ধুর জোরাজুরিতে যেতে হয়েছিল। মাত্র ঘণ্টা দুয়েক ওই বাড়িতে ছিলাম। রায়হানদের বাড়ি এখান থেকে ত্রিশ কিলো দূরে অন্য উপজেলায়। নদী তীরের লোক ওরা। কিছুটা নদী দেখার লোভ, কিছুটা বন্ধুর আবদার, দুই মিলেই যাওয়া বলা চলে।

নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে রায়হানদের বাড়ি। যমুনা নদী। পাড়ে দাঁড়ালে শুধু পানি আর পানি। প্রকৃতির এমন রূপ দেখে অনেক ভালো লাগল। গ্রামের আর দশটা বাড়ির মতোই সাদামাটা ঘরবাড়ি রায়হানদের। আমাদের বসতে দিল তার চাচার ঘরে। রায়হানের মুখে শুনেছিলাম, ওর চাচা নাকি দু-বার এই এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন। বিয়ে বাড়িতে সবার খাবারের জন্য বাড়ির বাহির আঙিনায় একেবারে নদীর কিনারে চটের ওপর বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে ওর চাচার ঘরে বসানো হলো। ঘরের একপাশে ডেকোরেটর থেকে নিয়ে আসা একজোড়া টেবিলের ওপর খবরের কাগজ বিছানো। আর প্লাস্টিকের চেয়ার পাতানো। আমরা সেখানটায় বসলাম। বাড়িঘর আর ভেতরের আসবাবপত্রের মাঝে সম্ভ্রান্তের কোনো ঘ্রাণ পেলাম না। খাট আর শোকেসের ডিজাইনই বলে দিচ্ছে আশপাশের মেলা থেকে কেনা। রায়হান আমাদের বসতে দিয়ে ওর স্বভাবসুলভ কথা বলল- চাচা খুব শৌখিন আর রুচিশীল লোক। দেখেন ফার্নিচারগুলো। সব পছন্দ করে কেনা। মুখে কথা এলেও কষ্টে আটকে রাখলাম। ওর সঙ্গে কী আর কথা বলব।

আমাদের খেতে দেওয়া হলো। রায়হানের চাচা এলেন। লম্বা ফর্সা মতন লোকটা অনেক মোটাসোটা। পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা। কথা বলেন উঁচু স্বরে। লম্বা সালাম দিয়ে বললেন- আর বলবেন না স্যার, এত মানুষের আয়োজন। লোকজনের দেখভাল করতেই দিশাহারা। আপনাদের কাছে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। এই তোরা কোথায়, এদিকে আয়। স্যারদের খেতে দে।

লুঙ্গি পরিহিত দু-তিনজন লোক বড় বড় কয়েকটি গামলা নিয়ে ঘরে ঢুকল। রায়হান পরিচয় করিয়ে দিল, ওরা রায়হানের ভাই। একজন কয়েকটা মেলামাইনের প্লেট নিয়ে এলো। আমরা খাবারের জন্য বসে পড়লাম। প্লেটগুলো থেকে এখনো কাগজের স্টিকার তোলা হয়নি। মনে হয় বাড়ির কারও বিয়ের অনুষ্ঠানে উপহার পেয়েছিল। আজই প্রথম বের করেছে। খাবারের বাসন আর তরকারির রঙ দেখে খাবার মুখে দেওয়ার রুচি হারিয়ে গেল। আস্ত একটা বালতি ভরে নিয়ে এসেছে ডাল। এই হলো রায়হানের সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিয়ে। এসব আর না বলি।

একেবারে অরুচির সঙ্গে দু-একবার মুখে একটু ভাত দিয়ে রায়হানের চাচার সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত থাকি। বেচারা প্রাণখোলা মানুষ। রান্নার জোগাড় যাই থাকুক, আপ্যায়নে আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। আমাদের সঙ্গে হাসিখুশিভাবে কথা বলছেন। রায়হানও আমাদের খাবার নিয়ে ব্যস্ত। আলাপচারিতায় রায়হানের চাচা বললেন- স্যার, এলাকার লোকজন সুবিধার না।

দু-বার মেম্বারের নির্বাচন করেছি। আমার টাকা খায়, ভোট দেয় অন্যজনকে। দুই দুইবার ফেল করে মাথা থেকে নির্বাচনের নাম ঝেড়ে ফেলেছি। ভেতরের কথা জেনে গেলাম সব। রায়হানের এতদিনের চাপাবাজি আজ শেষ হয়ে গেল। ওর কথা বন্ধ হয়ে গেল, দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ঘর থেকে উঠোনের পথ ধরে।

 
Electronic Paper