ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ | ১১ শ্রাবণ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বিচার

স্বাতী চৌধুরী
🕐 ৩:০৮ অপরাহ্ণ, জুন ১২, ২০২০

শিক্ষা পরিদফতর জানাল বিগত বছরের মতো এ বছরেও কোনো মেয়েশিশু স্কুলে ভর্তি হয়নি। বিষয়টা কী হল? এ তো দেখছি সিরিয়াস খবর। কিন্তু কারণটা কী? সরকার বিগত বছরগুলোতে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য এত কাজ করল, নারীশিক্ষার এত অগ্রগতি হল তাদের কর্মসংস্থান হল। ক্ষেতখামার থেকে সচিবালয়, নির্মাণ শ্রমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কল-কারখারখানা থেকে হাটবাজার সব জায়গায় নারীদের বিচরণ দৃশ্যমান হল! আর নারীর উন্নয়নে রাজ্য যখন বিশ্বের বুকে রোল মডেল হওয়ার কথা তখন কিনা হঠাৎ করে দু’বছর ধরে একটি মেয়েশিশুও স্কুলে ভর্তি হয়নি!

না, এটা অবিশ্বাস্য। না এটা হতে পারে না। ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়িয়ে শিক্ষামন্ত্রী একই কথা বারবার বলতে লাগলেন। শিক্ষা সচিবের দিকে আঙুল নেড়ে বলতে থাকলেন কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে। সঠিক খবর তোমার লোক দেয়নি নিশ্চয়ই। খোঁজ নিয়ে দেখ তারা ভুল তথ্য সাপ্লাই করছে এবং এটা একটা ষড়যন্ত্র। 

আমি তবে বিষয়টা আবার খতিয়ে দেখছি স্যার।
হ্যাঁ তাই করো।
কিন্তু যতই খতিয়ে দেখা হল ফলাফল সেই আগেরটাই! গত দু’বছরে দেশের কোনো স্কুলে কোনো মেয়েশিশু ভর্তি হয়নি। বিষয়টি রাজ্যপ্রধানের কানে গেলে তিনি হুকুম করলেন- স্বাস্থ্য পরিদফতর কী করছে? অথবা পরিসংখ্যানের কাজ কী? তারা তো জন্মমৃত্যুর হিসাব রাখে, নাকি? তাদের জিজ্ঞাসা করে জানো, রাজ্যে কি কন্যাশিশুর জন্ম হচ্ছে না? শিক্ষা পরিদফতর থেকে এবার দ্রুতই ফাইল নড়ে। চিঠি যায় স্বাস্থ্য বিভাগ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোতে। ওই বিভাগ দুটিও নড়েচড়ে ওঠে। তারা চিরুনি চালিয়ে অভিযানে নামে। তদন্ত করে হতভম্ব হয়। এ কী সর্বনাশ!
স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ভয়ংকর তথ্য জানা যায়। রাজ্যে গত পাঁচ ছয় বছর ধরে কোনো কন্যাশিশুর জন্মই হয়নি। শিক্ষামন্ত্রী কাঁচঘেরা বন্ধ ঘরে বসে বিরক্তিতে বিড়বিড় করেন- কন্যাশিশুর জন্ম হল কি হল না সেটা দেখা কি আমার কাজ নাকি? সে স্বাস্থ্য বিভাগ দেখবে! যারা জন্ম-মৃত্যুর হিসাব রাখে তারা দেখবে! কন্যাশিশু ভর্তি হচ্ছে না আমার তাতে কী? আমি দেখব যারা স্কুল-কলেজে ভর্তি হয় তারা পড়াশোনা করতে আসছে কিনা। শিক্ষার পার্সেন্টেজ বেড়ে রাজ্যকে বিশ্বের বুকে শিক্ষিত হিসেবে কতখানি এগিয়ে দেওয়া গেল কোয়ালিটি সে যাই হোক না কেন? আমার এত কিছু দেখার সময় কই? কিন্তু রাজ্যপ্রধান যখন প্রশ্ন করেন একটা শব্দ উচ্চারণেরও সাহস হয় না তার।
পাঁচ ছয় বছর রাজ্যে কন্যাশিশুর জন্ম হচ্ছে না খবরটি শেষপর্যন্ত আর চাপা থাকল না। সকল প্রকার মিডিয়া জেনে গেল, পাবলিক জেনে গেল এবং তা নিয়ে রাজ্যময় হৈচৈ শুরু হলে অবশেষে রাজ্যপ্রধানের কানেও গেল। তিনি তর্জনগর্জন শুরু করলেন। তথ্যটি স্বাস্থ্য ও পরিসংখ্যান এতদিন চেপে রাখল কেন? কেউ কোনো জবাব দিল না। নতমুখে সব ভর্ৎসনা হজম করে গেল। তিনি আবারও হুকুম করলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ, পরিসংখ্যান বিভাগসহ সকলে খোঁজ নাও কেন এই অঘটন ঘটছে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গত পাঁচ ছয় বছর ধরে মহিলারা প্রেগন্যান্ট হলেই নাকি সনোলজিস্টের মাধ্যমে আগে জেনে নিয়েছে তার গর্ভের ভ্রণটি ছেলে নাকি মেয়ে। মেয়ে জানলেই গর্ভপাত করে তার জন্মের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ তারা মেয়েশিশুকে জন্ম দিতে ইচ্ছুক নন। নারীদের এই ইচ্ছার সুযোগ লুফে নিয়েছে রাজ্যের প্রায় সকল প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো। তাদের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠল সে খবরও কেউ রাখেনি। এবার ক্লিনিক মালিকদের তলব করা হল- কেন তারা এই অপকর্ম করছে? তারা জবাব দিল, আমরা তো কাউকে ডেকে আনি না। লোকজন আসে। আমরা আমাদের কাজ করি।
ক্লিনিক মালিকের জবাবে প্রশাসন এবং কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট। ওদের তারা ছেড়ে দিল। তাহলে মূল আসামি কে? কে আবার, যারা কন্যাশিশুকে জন্ম না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে গর্হিত অপরাধ করেছে তারাই। তাহলে ধরে আনো তাদের। পাঠাও শূলে। দেখে সতর্ক হবে অন্যরা। এত বড় সাহস! মেয়ের জন্ম দেবে না! সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনুমতি নিয়েছিস কারো?
থানা আদালতে গ্রেফতারকৃত লক্ষ লক্ষ প্রজননক্ষম নারী। কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। কাঠগড়ায় আসামি মায়েরা। রাষ্ট্রপক্ষের উকিল সওয়াল জবাব নিচ্ছে- কেন তোমরা কন্যাশিশুর ভ্রণ হত্যা করছ? কেন তোমরা কন্যাশিশুর জন্ম দাওনি?
আসামিদের চোখে মুখে কোনো ভয় নেই। তাদের মুখে ব্যঙ্গের হাসি, চোখে আগুন। তারা একেকজন জবাব দেয় আর আদালতের কাঠগড়ায় আগুন জ্বলে ওঠে।
জরায়ু আমাদের। সেখানে পুত্র কন্যা যা কিছু জন্ম দেওয়ার অধিকার তো আমাদেরই নাকি? এর জন্য আমরা আসামির কাঠগড়ায় কেন দাঁড়াব? আমাদের কন্যাসন্তান জন্ম না দেওয়া কি অপরাধ?
হ্যাঁ অপরাধ।
কেন কন্যাসন্তান দরকার কেন? ওরা না হলে কার কী ক্ষতি হবে?
কন্যাসন্তানের জন্ম না হলে ভবিষ্যতের মা হবে কে? ভবিষ্যতে কেউ মা না হলে পুত্রসন্তান জন্ম দেবে কে?
ও তাই বলেন। পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য ভবিষ্যতের মা দরকার? বিষয়টা এতদিনে বুঝেছেন আপনারা? তার মানে আপনাদের পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার মেশিন চাই?
শুধুই কি ভবিষ্যতের মা? নাকি দেশে ধর্ষণ করার মতো কন্যাশিশু পাওয়া যাচ্ছে না এবং ভবিষ্যতে ধর্ষণ করার জন্য কিশোরী তরুণী গৃহবধূ নারী পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা?
নারী কি শুধুই মেশিন? জন্ম দেওয়ার মেশিন, পুরুষকে শারীরিক সুখ দেওয়ার মেশিন? সেই মেশিনের প্রোডাকশন বন্ধ হয়ে গেল বলে রাষ্ট্রযন্ত্রের এত চিন্তা?
এত কথা বলো না। যা জানতে চাওয়া হয়েছে শুধু তার জবাব দাও। বলো তোমরা কেন কন্যাশিশুর জন্ম দেবে না? জন্ম দেওয়া তোমাদের কর্তব্য। এটা রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন না করে তোমরা গর্হিত অপরাধ করেছ।
তাই যদি হয় অর্থাৎ নারীর প্রজনন কাজ বা কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়া রাষ্ট্রের কাজ তাহলে সেই জন্মদানের সময় কি রাষ্ট্র প্রসূতির পাশে থাকে? সেই কন্যাশিশুর দায়িত্ব নেয়? তার খাবার, তার চিকিৎসা, তার শিক্ষা এবং তার নিরাপত্তার ভার নেয়? যখন কোনো মায়ের কন্যাসন্তান ধর্ষিত হয়, কিশোরী বা তরুণীকন্যা ধর্ষিত হয়, উত্যক্তের শিকার হয় তখন কি রাষ্ট্র তার পাশে থাকে? যখন সেই মায়েরা বিচারের জন্য সকলের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়ায় তখন কি কেউ তার পাশে থাকে? অগণিত কিশোরী, তরুণী ও শিশুর পাশে ছিল কেউ? এ রাষ্ট্র, প্রশাসনের কর্তা, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, পুলিশ সকলেই ধর্ষকের পক্ষে থাকে। ধর্ষিতের ফরিয়াদ কেউ শোনে না। তাই কোনো ধর্ষকের জন্য আমরা আর কন্যাসন্তান জন্ম দেব না। তাতে আপনাদের বিচারব্যবস্থায় যে শাস্তি দেন মাথা পেতে নেব।
আসামিদের প্রশ্নবাণে একসময় কাঠগড়ায় নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কোনো উকিল আর কথা বলে না। বিচারক পাথরের মতো তার আসনে জমে থাকেন। জুরি বোর্ড চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায়। একসময় বিচারক উঠে দাঁড়ান। জোড় হাতে আসামি মায়েদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন- আমাদের ক্ষমা করো জননীরা। তোমরা যদি সিদ্ধান্তে অটল থাকো তবে যে সৃষ্টি রসাতলে যাবে। দয়া করো জননীরা, দয়া করো।
এক আসামি মা তির্যক হাসি দিয়ে বলেন, আপনি বাবা বিচারক মানুষ, যুক্তি বুদ্ধি আছে বলে বুঝতে পেরেছেন নারীর মূল্য। কিন্তু আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যতদিন না এ রাজ্য, রাজ্যের সিস্টেম না বদলাবে, যতদিন না নারী শুধু কোনো মা নয়, স্ত্রী নয়, কন্যা নয়, কোনো পণ্য নয়, কোনো ভোগ্যবস্তু নয় সে শুধুই মানুষ এবং মানুষ হিসেবে মানুষের মতো মানুষের অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে তার বাঁচার অধিকার আছে কথাটা সকলে স্বীকার করবে এবং যতদিন না সকল পুরুষ নারীর এই মূল্য না বুঝবে ততদিন এ রাজ্যে কোনো কন্যার জন্ম হবে না।
বিচারক তবু দাঁড়িয়েই থাকেন। কিন্তু আসামি মায়েদের আশ্বস্ত করার মতো কিছু বলতে পারেন না।

 
Electronic Paper