জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশে তাসাউফপন্থিদের ওপর আক্রমণ থামছেই না। গত দেড় বছরে দেশে ৮০টিরও বেশি মাজার, দরবারে হামলা হয়েছে। মাজারের মৃত পীরকে কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটেছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় সংগীতের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ এ তালিকায় যোগ হয়েছে মানিকগঞ্জের বিখ্যাত শিল্পী আবুল সরকারকে গ্রেফতারের ঘটনা। কয়েক দিন আগে একটি অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশনের সময় ধর্ম অবমাননা ও কটূক্তির অভিযোগে করা মামলায় আবুল সরকারকে গ্রেফতার করা হয়। এ গ্রেফতারের প্রতিবাদে তাসাউফপন্থিরা মানব বন্ধন করতে গেলে তৌহিদি জনতা তাদের ওপর আক্রমণ করে। হামলা থেকে বাঁচতে কয়েকজন পুকুরে ঝাঁপ দিয়েও রেহাই পাননি। ক্রমাগত তাদের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়ে আহত করা হয়।
শুধু আবুল সরকার নন, এর আগে ২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একইভাবে পালাগানের আসরে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন বাউলশিল্পী রিতা দেওয়ান, শরিয়ত সরকার। সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু বাউল-ফকিরদের ওপর জেল-জুলমের শেষ হয় না।
গত বছর যশোরে বাউলশিল্পীদের দুই দিনব্যাপী সাধুসংঘের আয়োজন করতে দেওয়া হয়নি। এ বছরও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেখা যায়। জানুয়ারিতে ফতুল্লায় বাউলগানের আসর বন্ধ করে পুলিশ কর্তৃক বাদ্যযন্ত্র জব্দ, প্রয়াত বাউলশিল্পী রশিদ সরকারের ‘সাধুর মেলা’ বন্ধসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাউলগানের আসর বন্ধ করে দেয় তৌহিদি জনতা নামধারি একদল লোক। বাংলায় ধর্ম প্রচার, কিংবা সুফিবাদ চর্চায় যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, সেই ফকির-বাউলদের গলা ছেড়ে গান গাওয়ার স্বাধীনতা রুদ্ধ করতে চায় একটি গোষ্ঠী। তাদের জুলুম থেকে উদারপন্থি মানুষগুলোকে কি আমরা মুক্ত করতে পারব না? প্রশ্ন হলো, এই তাসাউফপন্থিরা বার বার আক্রমণের শিকার হয় কিন্তু রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা দিতে এত অনীহা দেখায় কেন? রাষ্ট্র কি সবার হয়ে উঠতে পারেনি? এদেশের তাসাউফপন্থিদের সাবহিউম্যান হিসেবে ট্রিট করছে রাষ্ট্র। সুফি গায়ক, পালাকার, বয়াতি, বাউলরা যুগে যুগে ধর্মের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। সংগীতের মাধ্যমে মানুষের ভেতরের সুবোধকে জাগিয়ে তুলতে তারা কাজ করে যাচ্ছে। অথচ তারাই বার বার জুলুমের শিকার হচ্ছে।
ফকির, পালাকার, বয়াতি, বাউলরা ধর্মবিরোধী মানুষ নন। তারা নাস্তিকতার প্রচারণা করেন না। বরং তারা নানান গল্প ও সংগীতের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনে ধর্মের সারকথা (এসেন্স) ঢুকিয়ে দেন। মানুষকে প্রেম ও দরদের দাওয়াত দেন। লোভ ও হিংসা দূর করে জীবসত্তাকে পরমসত্তার সঙ্গে মিলনের পথ দেখায় তারা।
অথচ এই মানুষগুলো সব সময় একটি গোষ্ঠীর আক্রোশের শিকার। আগের সরকারগুলোর সময়ও হয়েছেন, এখনো হচ্ছেন। গত এক-দেড় বছরে মাজার-খানকায় হামলার মধ্য দিয়ে এর মাত্রা বেড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গতকালের তৌহিদি জনতার মিছিলে সুফি গায়ক-বাউল-বয়াতিদের বিরুদ্ধে যেসব ভয়াবহ স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, তা খুবই ভয়ানক। বাউল-ফকিরদের হত্যাযোগ্য করার জন্য সম্মতি উৎপাদনের যে ভয়ংকর প্রক্রিয়া গতকালের মিছিলে লক্ষ্য করা গেছে তা এখনি থামাতে হবে। এ ধরনের প্রবণতা একটি উদার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল্যবোধের অন্তরায়।
মনে রাখতে হবে, এ দেশ আমাদের সবার। সবার জন্য নিরাপদ ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণে সরকারকে কঠোর ও দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এটা করা না গেলে, বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
কেকে/এআর