ভয়াবহ এক ভূমিকম্পের সাক্ষী হলো বাংলাদেশ। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের ভূমিকম্পের কথা আমাদের স্মরণ আছে। গত মার্চ মাসে মিয়ানমারের ভূমিকম্পের পর আমাদের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে অনেক লেখালিখি হয়েছে। কারণ, আমাদের ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলো এতে আরো শক্তি সঞ্চয় করেছিল।
রাজউকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৪০.২৮ থেকে ৬৫.৮৩ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে। এতে সময়ভেদে প্রাণহানির সংখ্যা ব্যাপক হতে পারে- ভোরে হলে ২.১ থেকে ৩.১ লাখ, দুপুরে ২.৭ থেকে ৪ লাখ এবং রাতে হলে ৩.২ থেকে ৫ লাখ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। একইভাবে, সিলেটে যদি ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তাহলে ঢাকায় ৪০,৯৩৫ থেকে ৩ লাখ ১৪ হাজার ভবন- অর্থাৎ মোট ভবনের ১.৯১ শতাংশ থেকে ১৪.৬৬ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
কয়েকমাস যেতে না যেতেই ২১ নভেম্বর রাজধানী ঢাকা এবং সারা দেশে অনুভূত শক্তিশালী ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ১০ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বহু মানুষ আহত হয়েছেন এবং বেশ কয়েকটি ভবন ও স্থাপনায় ফাটল দেখা গেছে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস-এর তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পটির মাত্রা ৫ দশমিক ৫। এর কেন্দ্রস্থল নরসিংদী। ভূপৃষ্ঠের মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। এদিকে রাজধানী ছাড়াও গোপালগঞ্জ, নড়াইল, রংপুর, সাতক্ষীরা, যশোর, কুমিল্লা, রাজশাহী, কুড়িগ্রাম, সিলেট, ফেনী, মাদারীপুর, ঝালকাঠি, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এমনকি ভারতেও এর প্রভাব ছিল বলে এনডিটিভি জানিয়েছে।
শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটের সময় রাজধানীর পুরান ঢাকার বংশালের কসাইটুলীতে একটি ভবনের নিচতলায় নয়নের মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা। হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হয়। তীব্র ঝাঁকুনিতে দোকানের সামনে থাকা ক্রেতাদের ওপর ভবনের ছাদের রেলিং ভেঙে পড়ে। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন রাফিউল ও তার মা নুসরাত। স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। রাফিউলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
সকালে ছেলে মেহরাব হোসেন রিমনকে নিয়ে মাংস কিনতে বেরিয়েছিলেন আবদুর রহিম। ভূমিকম্পের পর রহিমের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন, তাদের দুজনেরই মুঠোফোন বন্ধ। পরে সন্দেহ হওয়ায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে গিয়ে বাবা-ছেলের লাশ শনাক্ত করেছেন পরিবারের সদস্যরা।
ইতিহাসে কিছু ভয়াবহ ভূমিকম্পের দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৭৬২ সালের ‘গ্রেট আরাকান আর্থকোয়েক’ ছিল প্রায় ৮ দশমিক ৫ মাত্রার, যার অভিঘাত পৌঁছেছিল চট্টগ্রাম, ফেনী ও কুমিল্লা পর্যন্ত। ১৮৯৭ সালে আসামে ঘটে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার আরো একটি বড় ভূমিকম্প। এরপর ১৯১৮ সালে সিলেটের বালিসিরা উপত্যকায় ৭ দশমিক ৬ এবং ১৯৩০ সালে আসামের ধুবড়িতে ৭ দশমিক ১ মাত্রার কম্পন রেকর্ড করা হয়।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, বুয়েটের পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প-বিশেষজ্ঞ মেহেদি আহমেদ আনসারী মনে করেন, এ কম্পন নতুন কোনো বিস্ময় নয়। তার ভাষায়, এ অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক বাস্তবতায় আরো বড় ধরনের ভূমিকম্পের শঙ্কা অনেক দিন ধরেই ছিল।
তিনি আরো বলেন, মাত্রা যদি ৬-এর কাছাকাছি পৌঁছায়, তাহলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ২১ নভেম্বর ভূমিকম্পটা বলতে পারি একটা ফোরশক। অর্থাৎ বড় ভূমিকম্প আসার আগে যে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়, তার অন্যতম।’
মিয়ানমারের ভূমিকম্পের কথা একটু স্মরণ করছি। গত ২৮ মার্চ শুক্রবার মধ্য মিয়ানমারের সাগাইং শহরে আঘাত হানে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প। এরপর আরো চারটি পরাঘাত আঘাত হেনেছে, যার একটির মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৮। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের হিসাবে, রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার প্রথম ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের ১৭ দশমিক ২ কিলোমিটার দূরে, মাটির ১০ কিলোমিটার গভীরে। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে দেশটিতে শক্তিশালী ছয়টি ভূমিকম্প হওয়ার ইতিহাস আছে। মিয়ানমারের উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত সাগাইং চ্যুতিরেখা। সে কারণে প্রায়ই ভূমিকম্প হয় মিয়ানমারে।
বিবিসির খবরে বলা হয়, ভূমিকম্পের পর মিয়ানমারে তথ্য পাওয়াটা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। আক্রান্ত এলাকার মোবাইল নেটওয়ার্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ ও ইন্টারনেট সেবার বাইরে চলে গেছেন লাখ লাখ মানুষ। ভেঙে পড়েছে বহু এলাকার বাড়িঘর, উপসনালয়, উপড়ে গেছে গাছ। ফাটল ধরেছে রাস্তায়, ভেঙে গেছে সেতু, বিদ্যুতের খুঁটিও উপড়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষ খাবার, পানি ও আশ্রয়হীন অবস্থায় দিন পার করছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তি বিবিসিকে বলেন, ‘এ যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত একটা শহর। কেউ কেউ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছেন। এটা (ভূমিকম্প) খুবই মারাত্মক আকারের ছিল। এত তীব্র কম্পন আমি আগে কখনো অনুভব করিনি।’ আমেরিকার ভূবিজ্ঞানীর মতে, মায়ানমারের নিচে ভারতীয় এবং ইউরেশীয় পাতের সংঘর্ষের ফলে অন্তত ৩৩৪টি পরমাণু বোমার সমান শক্তি নির্গত হয়েছে। তার ফলেই এই ভূমিকম্প।
ভয়ানক এক ভূমিকম্প ১৯৭৬ সালের ২৭ জুলাই চীনে সংঘটিত হয়েছিল। ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল তাংশান। এর ভয়াবহতা বেইজিং পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। সরকারি হিসাব মতে মৃতের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার। কিন্তু অনেকের মতে তা ৬ লাখ ৫৫ হাজারেরও বেশি। গত ৪০০ বছরে এটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় ৯.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকা ভূমিকম্পের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।
ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ এলাকাগুলোর ভূগর্ভস্থ স্তরে বেশ কয়েকটি সক্রিয় ফাটল রয়েছে, যা যে কোনো সময় শক্তিশালী ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। ঢাকার মতো মহানগরগুলোতে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমিকম্প প্রতিরোধী নীতিমালা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। অধিকাংশ পুরোনো ভবন ও অপরিকল্পিত বহুতল ভবন ভূমিকম্প প্রতিরোধী নীতির বাইরে নির্মিত, যা বড় ভূমিকম্পের সময় ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে পারে। শুধু তাই নয়, ঢাকার মাটির গঠনও ভূমিকম্পের সময় কম্পন বৃদ্ধি করতে পারে, যা ভবন ধসে পড়ার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। দুর্বল অবকাঠামো, সরু গলি, অপর্যাপ্ত উদ্ধারকর্মী ও দুর্বল জরুরি সেবা ব্যবস্থার কারণে অনেকে হতাহত হতে পারেন। গ্যাস লাইন, বৈদ্যুতিক লাইন ও রাসায়নিক গুদামগুলো ভূমিকম্পের সময় বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, যা ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
দেশের বিভিন্ন শহরে অপরিকল্পিতভাবে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে, যা বড় ধরনের ভূমিকম্পে ধ্বংসযজ্ঞের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তুলছে। তাই এখন থেকে সরকারের তদারকি প্রয়োজন। বিভিন্ন ভবনের পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান গার্মেন্টস ভবন এবং বিভিন্ন কারখানা ভবনের কাঠামো পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের ভবনগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা জরুরি। কারণ বহু স্থাপনা এখনো বিল্ডিং কোড মেনে নির্মিত হয়নি বলে অনেকে অভিযোগ করেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
কেকে/এমএ