দুপুরের পর হালকা ধাক্কার মতো শুরু হওয়া যে কম্পন দ্রুতই প্রবল এক ঝাঁকুনিতে পরিণত হলো- তার উৎপত্তিস্থল মাধবদী। আগারগাঁও সিসমিক সেন্টার থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরের এই কেন্দ্র বাংলাদেশকে আবারো স্মরণ করিয়ে দিল- আমরা এক ভূমিকম্প-ঝুঁকির চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। রিখটার স্কেলে বাংলাদেশ জানিয়েছে ৫.৭ মাত্রা, যুক্তরাষ্ট্র ৫.৫।
মাত্রাতেই হোক পার্থক্য, কিন্তু ক্ষতিটা বাস্তব- ১০ জনের মৃত্যু, শত শত মানুষ আহত, বহু ভবনে ফাটল, কয়েকটি হেলে পড়া, বিদ্যুৎকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ড, মাটি ফেটে যাওয়া, আর ঘরের জিনিসপত্র ছিটকে পড়া। প্রশ্ন এখন একটাই- আরেকটু বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে আমাদের কি হবে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আতঙ্ক নয়, কঠিন বাস্তবতাই সামনে আসে। দেশের অন্যতম কাঠামো-প্রকৌশলী শামীমুজ্জামান বসুনিয়া সেপ্টেম্বরেই সতর্ক করেছিলেন-‘ভূমিকম্প হলে যারা বেঁচে যাবে তারাও থাকতে পারবে না।’ তার অভিমত ছিল, আগুন, পানি ও পয়ঃপ্রণালির নাজুক অবস্থা এমন হবে যে, উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতেও পারবেন না, দুর্গন্ধে পরিবেশ অচেনা হয়ে যাবে।
তিনি আরো বলেছিলেন, দেশে দেড় লাখ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ- বরং বাস্তবে ‘অল্প কিছু ভবন ছাড়া সবই ভঙ্গুর।’ এ সতর্ক বার্তাগুলোকে এখন হালকা করে দেখার আর সুযোগ নেই। কারণ ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন- এ অঞ্চলে ভূমিকম্প প্রতিদিনই হচ্ছে, ২-৩ মাত্রার কম্পনগুলো আমরা টেরই পাই না। ডাউকি ফল্টসহ একাধিক সক্রিয় ফল্টলাইনের ওপর রয়েছে বাংলাদেশ। যে কোনো সময় যে কোনো একটি ফল্টের সামান্য পরিবর্তন ভয়াবহ বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে।
৫.৫-৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পই যখন বহুতল ভবনে ফাটল ধরিয়ে শ’খানেক মানুষকে আহত করতে পারে, তখন ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির কথা কল্পনাই শিউরে ওঠার মতো। আমাদের নগরায়ণ নিয়ন্ত্রণহীন, ভবন নির্মাণে অনিয়ম স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, জরুরি সেবার অবকাঠামো দুর্বল, উদ্ধার প্রস্তুতি সীমিত। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো- নাগরিক নিরাপত্তার প্রশ্নে প্রশাসনিক উদাসীনতা। আমরা ভুলে যাই, ভূমিকম্প কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়। এটি না সরকার দেখে, না বিরোধী দল দেখে- এটি কেবল মানুষ ধ্বংস করে।
তাই এখনই জরুরি তিনটি পদক্ষেপ- ১. ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা। আইন প্রয়োগে শূন্য সহনশীলতা। ২. ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, সেনাবাহিনীসহ সব বাহিনীর সমন্বয়ে সমন্বিত মহড়া ও প্রশিক্ষণ। ৩. স্কুল, কলেজ, অফিস- সব জায়গায় ভূমিকম্প-সচেতনতা বাধ্যতামূলক করা।
আসলে আমরা আর ‘সতর্ক বার্তা’ পর্যায়ে নেই- এখন ‘সতর্ক সংকেত’ বাজছে। এই ভূমিকম্প আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে- ঢাকা ও আশপাশের শহরগুলো এক বড় বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্যই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকানো আমাদের হাতে নেই, ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্পূর্ণই আমাদের হাতে। আর সেই প্রস্তুতি নেওয়ার সময়টা এখনই।
কেকে/এমএ