বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫,
১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: ধর্মের অপব্যাখ্যা করে বিশৃঙ্খলা তৈরির সুযোগ দেয়া হবে না : ধর্ম উপদেষ্টা      ডেঙ্গুতে মৃত্যু আরও সাত, হাসপাতালে ভর্তি ৫৬৭      ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফের ভূমিকম্প      দুদকের সব কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক সম্পত্তির হিসাব দিতে হবে      প্রাথমিক শিক্ষকদের লাগাতার কর্মবিরতি      নির্বাচনী জোটের আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে : রাশেদ খান      গণতন্ত্র ফেরাতে নির্বাচনের বিকল্প নেই : আমান      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
বাংলাদেশে বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে কন্যাসন্তানের অধিকার ও করণীয়
স্বপন বিশ্বাস
প্রকাশ: শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৫, ৩:৩৩ পিএম
ছবি: প্রতিনিধি

ছবি: প্রতিনিধি

বাংলাদেশে হিন্দু আইনে পিতা-মাতার সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার প্রশ্নটি বহুদিন ধরে বিতর্ক, বৈষম্য ও বাস্তবজীবনের বেদনাময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। সমাজে নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক মর্যাদা যতই বেড়ে উঠুক, উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রে হিন্দু নারীরা এখনো বহু সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি। হিন্দু উত্তরাধিকার আইন মূলত দায়ভাগ পদ্ধতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে কন্যার অধিকার ‘স্থায়ী মালিকানা’ নয় বরং ‘জীবনস্বত্ব’ বা সীমিত ভোগদখলে সীমাবদ্ধ। 

অর্থাৎ কন্যা সম্পত্তিতে বসবাস বা ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু সে সেই সম্পত্তির প্রকৃত মালিক নয়, বিক্রি বা দান করতে পারে না, আর তার মৃত্যুর পর সে সম্পত্তি আবার পুরুষ সদস্যদের কাছেই ফিরে যায়। এই ব্যবস্থায় নারীকে মানুষ হিসেবে স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি হিসাবে নয়, বরং অস্থায়ী ভোগকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়- যা আধুনিক মানবাধিকার ও সমতার ধারণার সঙ্গে পুরোপুরি অসঙ্গত।

এই বৈষম্যের গভীরে রয়েছে সমাজের দীর্ঘ পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা। বহু পরিবারেই আজও মনে করা হয়, কন্যা তো ‘পরের বাড়ির মানুষ’, তাই পিতৃভিটায় তার পূর্ণ অধিকার থাকা উচিত নয়। আবার পরিবারের অশান্তি বা ‘ভালো মেয়ে’ হওয়ার চাপ অনেক সময় কন্যাকে নিজের ন্যায্য অংশ দাবি করতেও বাধা দেয়। বলা হয়, মেয়ে তো বিয়ের সময়ই যথেষ্ট উপঢৌকন পেয়েছে। কিন্তু আইনগতভাবে উপঢৌকন বা স্ট্রিধন কোনোদিনও পিতা-মাতার সম্পত্তির বিকল্প নয়। তাই বাস্তবে দেখা যায়, অধিকাংশ কন্যাই তাদের জন্মগত অধিকার বুঝে উঠতে পারেন না, দাবি করতেও সাহস পান না। হিন্দু আইনের আরেকটি বড় সমস্যা এর পুরোনো কাঠামো। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ কোনো সময়েই আধুনিক ও লিঙ্গ-সমতাভিত্তিক হিন্দু উত্তরাধিকার আইন প্রণয়ন করেনি। 

ভারতে ২০০৫ সালেই কন্যার পূর্ণ ও সমান অধিকার নিশ্চিত হয়েছে, অথচ বাংলাদেশে এখনো একই পুরোনো আইন বলবৎ। যদিও উচ্চ আদালত কয়েকবার সরকারের নিকট প্রশ্ন তুলেছেন-কন্যারা কেন পিতার সম্পত্তিতে সমান অংশীদার হবে না, তবুও আইন সংস্কারে কার্যকর অগ্রগতি দেখা যায়নি। সরকারিভাবে খসড়া প্রণয়নের আলোচনা বহু বছর ধরেই চলছে, কিন্তু বাস্তবে সেই আইন আর সংসদে উঠছে না; ফলে হিন্দু নারীরা আজও একই শৃঙ্খলে আবদ্ধ। আইনগত সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি রয়েছে প্রশাসনিক ও সামাজিক জটিলতা। উত্তরাধিকার কেস করতে গেলে মামলা দীর্ঘ হয়, খরচ বেশি, কাগজপত্র সংগ্রহ কঠিন- এ সবই নারীর সামনে অতিরিক্ত বাধা সৃষ্টি করে। পরিবারের পুরুষরা প্রাধান্য পায়, আর নারীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, ভয় দেখিয়ে বা সামাজিক চাপে তার অংশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। গ্রামাঞ্চলে ততোধিক কঠিন। সেখানকার প্রচলিত ‘সামাজিক আইন’ প্রায়ই রাষ্ট্রীয় আইনকে অস্বীকার করে। একদিকে বৈষম্যমূলক আইন, অন্যদিকে সামাজিক মনোভাব। ফলে হিন্দু নারীরা সম্পত্তির মালিকানা থেকে বহু দূরে রয়ে যায়। 

কন্যার অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজন একযোগে আইন, সমাজ ও প্রশাসনের পরিবর্তন। প্রথমত, হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সংস্কার আর বিলম্ব না করে দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত, এমনভাবে যাতে কন্যা ও পুত্র সমান মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের অধিকার পায়। শুধু জীবনস্বত্ব- স্থায়ী মালিকানা, হস্তান্তর, বিক্রয়, দান। সব ক্ষেত্রেই নারীর পূর্ণ আইনগত অধিকার থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, আইনের পাশাপাশি সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। পরিবারে কন্যাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কোনো ধর্মীয় বা নৈতিক দায়িত্ব নয়- বরং তাকে অধিকার দেওয়া মানবিক, ন্যায়সঙ্গত ও সাংবিধানিক কর্তব্য। সচেতনতা বাড়াতে সামাজিক সংগঠন, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় নেতৃত্ব- সবার অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এ ছাড়া নারীদের জন্য আইনগত সহায়তা, পরামর্শ, মামলা পরিচালনার জন্য বিশেষ সেল থাকা উচিত, যাতে তারা ভয় ছাড়াই তাদের অধিকার দাবি করতে পারে। 

প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও প্রয়োজন জমির রেকর্ড ডিজিটালাইজেশন, দ্রুত নিষ্পত্তি ব্যবস্থা এবং নারী-বান্ধব সেবা কাঠামো। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দুই স্তরেই নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত না হলে, কোনো আইনই কার্যকর হবে না। বাংলাদেশের সংবিধান নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথাই বলে। তাহলে হিন্দু কন্যা পিতা-মাতার সম্পত্তিতে সমান অংশ পাবে না কেন? প্রশ্নটি শুধু আইন বা ধর্মের নয়, এটি সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন। 

কন্যাসন্তান শুধু একটি পরিবারের সদস্য নয়- সে সমাজ, রাষ্ট্র এবং অর্থনীতির সমান অংশীদার। তার ওপর আইনগত বৈষম্য বজায় থাকলে দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। সময় এসেছে পুরোনো অনুশাসন ও অন্যায্য বিধানকে পেছনে ফেলে সব হিন্দু নারীর উত্তরাধিকার অধিকার পূর্ণরূপে স্বীকৃতি দেওয়ার। কন্যার অধিকার শুধু আইন সংশোধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়- এটি মানবাধিকারের, মর্যাদার ও ন্যায়ের দাবি। বাস্তবায়নই এখন সবচেয়ে জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক

কেকে/এমএ
আরও সংবাদ   বিষয়:  বাংলাদেশ   বাবা-মায়ের সম্পত্তি   কন্যাসন্তান   অধিকার   করণীয়  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

চুয়াডাঙ্গায় বীজ বিক্রিতে অনিয়মের দায়ে দুই প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
শ্রীপুরে ইভটিজিং ইস্যুকে কেন্দ্র করে স্কুলছাত্রের ছুরিকাঘাত, আহত ৬
শেখ হাসিনার আইনজীবী হিসেবে না লড়ার সিদ্ধান্ত জেডআই খান পান্নার
দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা শ্রীমঙ্গলে ১২.৫ ডিগ্রি
মোহনপুরে বিএসটিআই লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা

সর্বাধিক পঠিত

ইয়ুথ ফোরামের নবনির্বাচিত কমিটিকে ব্যারিস্টার খোকনের বরণ
পাটগ্রাম উপজেলায় সীমান্ত সুরক্ষা জোরদারে 'চতুরবাড়ী বিওপি'র যাত্রা
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফের ভূমিকম্প
নাগেশ্বরীতে ১০ টাকার স্বাস্থ্য সেবা চালু
দুই ট্রলারসহ সেন্টমার্টিনে ১২ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close