ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটরদের উপস্থিতি বাড়াতে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা চেয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল বুধবার দুই ধাপে ১১টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে এ কথা বলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোও নানা বিষয়ে কথা বলেন সংলাপে। এর মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ইসির কর্মকর্তাদের রাখার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী চায় ভোটের আগে লটারিতে প্রশাসনে বদলি হোক। এ ছাড়া এনসিপি আরপিওর ধারা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছে।
সংলাপের শুরুতে সূচনা বক্তব্যে (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, আচরণবিধির খসড়া করার সময় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের দেওয়া অনেকগুলো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি ওয়েবসাইটে দিয়ে জনগণ ও রাজনৈতিক দলের মতামত পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে সুন্দর নির্বাচনের জন্য আচরণবিধি প্রস্তুত নয়, পরিপালনটাই গুরুত্বপূর্ণ।
গত কয়েকটি নির্বাচনের কারণে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রবিমুখ হয়েছে উল্লেখ করেন নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, জনগণের মধ্যে একটা ভাবনা ছিল যে ভোট হয়তো আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের অঙ্গীকার করার আহ্বান জানান সিইসি।
এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান সংলাপে বলেন, নির্বাচনে কয়েক লাখ নির্বাচন কর্মকর্তা প্রয়োজন। ইসির এত লোকবল নেই। কিন্তু ইসির যতটুকু জনবল আছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। ৩০০ আসনে সরকারের কাছ থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ধার করে আনা হয়। ইসির এটুকু জনবল আছে। ইসির উদ্দেশে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘একবার সাহস করে এই সিদ্ধান্ত নেন যে রিটার্নিং অফিসার আপনাদের নির্বাচন কমিশন থেকে থাকবে। অ্যাসিস্ট্যান্ট রিটার্নিং অফিসার আপনাদের নির্বাচন কমিশনের ডেডিক্যাটেড লোকেরা হবেন। এই একটা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে।’
আবদুল মঈন খান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চারটি বোতাম আছে। একটি হচ্ছে ডিসি, একটি হচ্ছে এসপি, একটি হচ্ছে ইউএনও, আরেকটি হচ্ছে ওসি। এ চারটি বোতাম টেপা হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে, এরপর ৩০০ আসনে নির্বাচনের ফলাফল বের হয়ে আসে। এ পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তিনি এখানে ইসিকে শক্ত ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তারা ইসিকে সব সহায়তা করবেন। কিন্তু ইসিকে শক্ত থাকতে হবে। সরকারের কাছে ইসি নতজানু থাকলে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের লটারির মাধ্যমে বদলি চায় জামায়াতে ইসলামী। দলটি বলছে, বদলির ক্ষেত্রে এটিই সবচেয়ে নিরপেক্ষ ও আস্থা রাখার পদ্ধতি।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘এক মাসও হয়নি, ২০ দিনও হয়নি, একজন ডিসি সেখানে চলে গিয়েছেন (বদলি)। সেটাও হঠাৎ করে। আবার এই সপ্তাহের মধ্যে অনেককে রদবদল করা হয়েছে। এটার পেছনে মনে হয় যেন, কোনো একটা ডিজাইন করে। একটা উদ্দেশ্যে এই কাজটা কোনো জায়গা থেকে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘লটারির মাধ্যমে ট্রান্সফার করা হলে, যার যেখানে তকদির আছে, সে সেখানে চলে যাবে। এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকবে না।’
জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও নির্বাচনি আচরণবিধিতে তার উল্লেখ না থাকার বিষয়ে ইসির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মিয়া গোলাম পরওয়ার। পোস্টাল ব্যালটে প্রবাসীরা কীভাবে গণভোট দেবেন, সে বিষয় স্পষ্ট করার আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে প্রবাসী ভোটের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) বিকল্প হিসেবে পাসপোর্টের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করার বিধান করার বিষয়ে বলেন তিনি।
এদিকে নিবন্ধন পাওয়ার পর প্রথমবারের মতো গতকাল ইসির সংলাপে অংশ নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তাতে নির্বাচনি আচরণবিধি প্রয়োগ করার সামর্থ্য ইসির আছে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে দলটি।
নির্বাচনি আচরণবিধির ৭ ধারার চ উপধারাই ইসির ‘প্রথম পরীক্ষা’, এমন মন্তব্য করে এনসিপি নেতা জহিরুল ইসলাম সংলাপে বলেন, ‘বিএনপির বর্তমান প্রধান হচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। সে ক্ষেত্রে তারেক রহমানের ছবি বিএনপির কোনো প্রার্থী যদি ব্যবহার করেন, তাহলে কমিশনকে তার ওপর এই বিধিমালা প্রয়োগ করতে হবে। তখন এই কমিশনের সক্ষমতাটা দেখা যাবে।’
আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য যে নির্বাচনি আচরণবিধিমালা প্রণয়ন করেছে, তার ৭ ধারার চ উপধারায় বলা হয়েছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী কেবল তার বর্তমান দলীয় প্রধানের ছবি ব্যানার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল ও ফেস্টুন ছাপাতে পারবে। কোনো পোস্টারও ছাপানো যাবে না।
জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের গড়া দল এনসিপি সংলাপে বলেছে, এই আচরণবিধিমালা বাংলাদেশের নির্বাচনি সংস্কৃতি, নির্বাচনি উৎসবের আমেজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
জহিরুল বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সংক্ষুব্ধ কেউ তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ দিতে পারবেন, এমন কথা বিধিমালায় বলা আছে। তবে আইনের সংজ্ঞায় তদন্ত কমিটির কোনো সংজ্ঞায়ন করা হয়নি। প্রক্রিয়াটিকে জটিল এবং সময়ক্ষেপণের একটা উদ্দেশ্য আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, সবাই নির্বাচন কমিশনকে একটি জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু বিধিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যদি কমিশনের কোনো কর্মকর্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন, তার বিরুদ্ধে করণীয় কী হবে, এ বিষয়টিও স্পষ্ট নয়।
এদিকে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করাকেই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। সে জন্য ‘নির্বাচনি পরিবেশ মনিটরিং কমিটি’ গঠনের দাবি জানিয়েছেন তিনি। জোনায়েদ সাকির প্রস্তাবিত এই কমিটিতে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা থাকবেন। কমিটির কাজ হবে সংঘাত কমাতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো।
গতকালকের সংলাপের প্রথম ধাপে অংশ নেয় জামায়াত ইসলামী, এনসিপি, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজেপি), ইনসানিয়াত বিপ্লব, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি। পরবর্তী ধাপে অংশ নেয় বিএনপি, নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও রিপাবলিকান পার্টি।
কেকে/ আরআই