মৌলভীবাজার জেলার শস্য ভান্ডার খ্যাত কাউয়াদীঘি হাওর অধ্যুষিত রাজনগরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় চলতি রোপা আমন মৌসুমে দেখা দিয়েছে আশাতীত বাম্পার ফলন। দীর্ঘ প্রতিকূলতা, পাহাড়ি ঢল ও টানা বন্যার ক্ষতি পেরিয়ে বহু কৃষক পরিবার এবার নতুন স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নেমেছেন। মাঠজুড়ে এখন দোল খাচ্ছে সোনালি ধানের শীষ; উঠোনজুড়ে জমতে শুরু করেছে নতুন ফসল। হেমন্তের বাতাসে পাকা-আধাপাকা ধানের সোনালি সমারোহ যেন প্রকৃতির উৎসবে পরিণত হয়েছে।
রাজনগর, শ্রীমঙ্গল ও আশপাশের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়—ধান কাটার মহোৎসবে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক-কৃষাণী। কেউ কাটায়, কেউ ঝাড়াই-মাড়াইয়ে ব্যস্ত। রাজনগর উপজেলার কাশিমপুর, কেওলা ও আব্দুল্লাহপুর গ্রামের চাষিরা জানান, টানা দুই বছরের ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে এবার আমনের বাম্পার ফলনে তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার আশিদ্রোন খোসবাস গ্রামের কৃষক মো. শাকির আহমদ বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় এবার তীব্র আশংকা নিয়ে আমন চাষ করি। কারণ প্রতি বছরই ফসল ঘরে তোলার মূহুর্তে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে হাজার হাজার কৃষকের স্বপ্নের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এবারও এ আশঙ্কা করছিলাম। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়া ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের যথাযথ উদ্যোগের কারণে কৃষককুলের মুখে হাসির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। আমার জমিতে প্রতি কেয়ারে ১৫-২০ মন ধান পাব বলে আশা করছি।
রাজনগর কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর উপজেলায় আমন আবাদ হয়েছে মোট ১১ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমিতে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫৮৮ হেক্টর বেশি। এর মধ্যে কাউয়াদীঘি হাওরে ৫ হাজার হেক্টর এবং উজানে ৬ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ৯৮২ মেট্রিক টন চাল, যার সম্ভাব্য বাজারমূল্য ১৩৯ কোটি ৯২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
২০২২ ও ২০২৪ সালের বন্যায় রাজনগরের প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমির আমন ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেলে দরিদ্র কৃষকদের নেমে এসেছিল দুঃসময়। কিন্তু এবার সঠিক সময়ে বৃষ্টি ও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ হাওরে কুশিয়ারা নদীর পানি প্রবেশরোধে সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়ায় ধান রক্ষা সম্ভব হয়েছে।
রাজনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল আমীন বলেন, এবার আমনের ফলন লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। হাওর ও উজানজুড়ে প্রায় শতভাগ জমিতে ভালো ফলন হওয়ায় কৃষকের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটেছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে জানা যায়, চলতি চলতি আমন মৌসুমে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৮ হাজার ২৪৩ মেট্রিক টন ধান এবং ৪৫ হাজার ৪০ মেট্রিক টন চাল। তবে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ২০০ হেক্টর বেশি আবাদ হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আলাউদ্দিন বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকা এবং আকস্মিক বন্যা না হওয়ায় এ বছর আমন ধানের আবাদ ও ফলন দুটোই ভালো হয়েছে। নিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে রোগবালাইয়ের আক্রমণও কম ছিল। ফলে আমনের বাম্পার ফলনে কৃষকদের মুখে ফুটেছে আনন্দের হাসি। এই মৌসুমের প্রথম ধান কাটা উপজেলার সিন্দুরখান ইউনিয়নের কুঞ্জবন এলাকা থেকে শুরু হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই পুরো উপজেলায় পুরোদমে আমন ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হবে
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. জালাল উদ্দিন জানান, চলতি মৌসুমে ব্রি হাইব্রিড-৪, ব্রি হাইব্রিড-৬, তেজ গোল্ড, বিআর ১১, বিআর ২২, বিআর ২৩সহ বিভিন্ন উফশী জাতের ধান প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ফলন দিয়েছে। জেলার সাত উপজেলায় মোট ৯৮ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে রোপা আমন আবাদ হয়েছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, মৌলভীবাজারের আমন মৌসুম এবার কৃষকদের মাঝে নতুন আশা ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
কেকে/এআর