বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বণ। কার্তিক পূজা হিন্দুদের একটি পুজো। কার্তিক হল হিন্দু যুদ্ধদেবতা। দেবাদিদেব মহাদেব শিব ও দশভুজা দুর্গার আদরের ছোট পুত্র কার্তিক। গণেশ তার দাদা। তবে কোন কোন পুরাণে কার্তিককে বড় এবং গণেশকে ছোট পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব নিয়ে নানা মতপার্থক্যও আছে। কার্তিক বৈদিক দেবতা নন, তিনি পৌরাণিক দেবতা।
বরিশালের বানারীপাড়া পৌরসভার বাসস্ট্যান্ড ও হাসপাতাল সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী বনিক বাড়িতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে পালিত হয়েছে কার্তিক পূজা। বর্ণীল প্যান্ডেল, রঙবেরঙের আলোকসজ্জা ও ভক্তদের পদচারণা মুখরিত ছিলো পূজা মন্ডপের চারপাশ।
কার্তিক পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি সজল কর্মকারের সভাপতিত্বে এবং সম্পাদক তন্ময় বনিকসহ পুজা পরিষদের সকল সদস্যের সার্বিক তত্ত্বাবধানে কার্তিক পূজা উপলক্ষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেবসনাপতি কার্তিক দেবতার সম্মুখে ভক্তিমুলক সংগীত পরিবেশন করা হয়। ছোট, বড় সকলের অংশগ্রহণে আরতী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় অনুষ্ঠান শেষে প্রতিযোগীদের মাঝে পুরষ্কার বিতরণ করা হয়। বর্ণীল সাজসজ্জা, আলোকিত গেট,প্যান্ডেল, ঢোল-বাঁশি-সানাইসহ বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজানো, মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠান সব মিলিয়ে মনোরম পরিবেশের আকার ধারণ করেছিলো উৎসব অঙ্গন। মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) বাংলা ১ অগ্রহায়ণ প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতার সমাপ্তি ঘটে।
বানারীপাড়া কেন্দ্রীয় লোকনাথ মন্দিরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কার্তিক বনিকের সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন বানারীপাড়া উপজেলা পুজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি দেবাশীষ দাস, সম্পাদক গৌতম সমদ্দার, কেন্দ্রীয় শ্রীগুরু সংঘের সাংগঠনিক সম্পাদক বাবু ভক্ত কর্মকার, বানারীপাড়া শ্রীগুরু সংঘের সভাপতি জহর সাহা, সহ-সভাপতি মানিক বনিক, বানারীপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার অমিতাভ দাস, বন্দর মডেল সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক চন্দ্র শেখর দাস, কুন্দিহার সার্বজনীন কালী মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক দেব কুমার সরকার, রিপন বনিক।
উপস্থিত ছিলেন সুজন সাহা (পিকলু), প্রদীপ সাহা, বাপ্পি বনিক, অভিজিৎ বনিক, উত্তম বনিক, রাম পাল।
সজল কর্মকার বলেন, ‘বিগত বছরের তুলনায় এই বছরে বনিক বাড়ির কার্তিক পূজা জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। বনিক বাড়ির নারীদের লাল রঙের সুসজ্জিত কাপড়ে পূজার জল আনা থেকে শুরু করে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সমস্ত আয়োজন ছিলো উৎসবমুখর। গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও ভক্ত বৃন্দের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে পূজামণ্ডপ প্রাঙ্গণ।’
যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে পুজা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে তাদেরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি।
দেবী দুর্গা এবং শিবের পুত্র হলেন কার্তিক। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, কার্তিকের পুজো করলে পুত্রসন্তান লাভ হয়। কার্তিক ঠাকুর ধন এবং সংসারের শ্রীবৃদ্ধিরও দেবতা। এই দেবতার আরাধনায় সংসারের বিভিন্ন সময় সফলতা প্রাপ্ত হয়ে থাকে এবং আয়ের ক্ষেত্রেও উন্নতি হয়ে থাকে। জ্যোতিষশাস্ত্রের মতে, কার্তিকের আরাধনায় মঙ্গল গ্রহের সুফল দানের ক্ষমতাও বৃদ্ধি হয়।
কার্তিক পূজা প্রধানত সন্তানলাভ, বিশেষ করে পুত্রসন্তান প্রাপ্তির জন্য করা হয়। এছাড়া, এই পূজা সমৃদ্ধি লাভ ও সংসার জীবনে শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোর জন্য করা হয়ে থাকে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, কার্তিকের আরাধনার মাধ্যমে দম্পতিরা সুন্দর ও বলিষ্ঠ পুত্রসন্তান লাভ করেন এবং এর মাধ্যমে সংসারের সুখ সমৃদ্ধি বাড়ে। নবদম্পতি বা নিঃসন্তান দম্পতিরা কার্তিক ঠাকুরের পূজা করেন পুত্রসন্তান লাভের আশায়। ঐতিহাসিক ভাবেও নিঃসন্তান দম্পতিরা কার্তিক পূজা করে সন্তান লাভ করেছেন বলে জনশ্রুতি আছে, যেমন জমিদার জয়নারায়ণ পালের উদাহরণ।
দেবসেনাপতি কার্তিকের জন্ম হয়েছিল তারকাসুরকে বধ করার জন্য, তাই তিনি শক্তি ও বীরত্বের প্রতীক। এই শক্তি ও বীরত্বের প্রতীক রূপে কার্তিকের পূজা করা হয়। ব্রহ্মার বরে মহাবলী তারকাসুরের নিধনের জন্যই নাকি অমিত বিক্রম যোদ্ধা কার্তিকের জন্ম হয়েছিল। কেউ বধ করতে পারছিল না তারকাসুরকে। তার অত্যাচারে দেবকুল অতিষ্ঠ। আর দৈববলে অজেয় শক্তি সম্পন্ন এই দেবশিশু কার্তিকেয় তারকাসুর নিধন করেছিলেন । আর এই তারকাসুর নিধন করে দেবকুলে কার্তিক গেলেন দেবসেনাপতি। তাই, কার্তিকের পুজো হয় মহাসমারোহে। দেবতারূপে কার্তিক একসময়ে সারা ভারতীয় উপমহাদেশেই খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ভারতীয় পুরাণগুলির মধ্যে স্কন্দ পুরাণে কার্তিকের বিষয়ে সবিস্তারে লেখা আছে। তাছাড়াও মহাভারতে এবং সঙ্গম তামিল সাহিত্যে কার্তিকের নানা বর্ণনা রয়েছে। ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে বারোটি হাত যুক্ত কার্তিকের একটি অভিনব মূর্তি রক্ষিত আছে।
কেকে/এমএ