জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরেক আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। এটি জুলাই অভ্যুত্থানে সংগঠিত অপরাধ মামলার প্রথম রায়। এর মধ্য দিয়ে নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতের পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পতন ঘটে বাংলাদেশের দীর্ঘতম স্বৈরশাসনের। সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে হাসিনা ক্রমশ হয়ে উঠেছিলেন একজন কর্তৃত্ববাদী এবং ফ্যাসিস্ট শাসক। বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চালানো, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক কাঠামোবদ্ধ হত্যাকাণ্ড, গুম, জেল ও মামলা-হামলার মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও সুশাসনের কবর রচনা করেছিলেন তিনি।
২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোট, ২০১৮ সালে ‘দিনের ভোট রাতে’, আর ২০২৪ সালে সরকার নির্বাচনের নামে আমি-ডামির অভিনব নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কেবল দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ধ্বংস করেনি বরং দলের ভেতরেও প্রাণঘাতী সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে আওয়ামী নেতারা মনে করতেন তারাই বাংলাদেশ। যারা তাদের বিরোধিতা করবে, তারা দেশের শত্রু, জাতির দুশমন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যে দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ক্ষমতায় এসেছিল, তাদের আমলে সেটি আরো প্রসারিত হয়েছে। বেনজীর-মতিউরসহ দুর্নীতির বরপুত্রদের একের পর এক কেলেঙ্কারি বের হতে থাকলেও আওয়ামী সরকার তা আমলে নেয়নি। বিরোধী দলের কর্মসূচিকে প্রতিহত করতে ছাত্রলীগকে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো ব্যবহার করত আওয়ামী লীগ। প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির অনেক নেতাকর্মীকে বছরের পর বছর ধরে মিথ্যে মামলায় কারাবন্দি করে রাখা হয়েছিল। বিরুদ্ধ মতের নেতা, বুদ্ধিজীবীদের নির্যাতনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল আয়নাঘর। এসব ক্রিয়াকর্ম জুলমের রাজনীতি আওয়ামী লীগকে ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন করেছে।
যে কোটা আন্দোলনের সূত্র ধরে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে হয়েছে- সেই কোটা আন্দোলন দমনে দলের সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দিয়েছিলেন, এদের দমন করতে তাদের ছাত্রলীগই যথেষ্ট। এ ধরনের দাম্ভিক প্রবণতা দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যেও প্রবল ছিল। ১৮ সালের কোটা আন্দোলন, শিশু কিশোরদের সড়ক আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশ বাহিনী দ্বারা ব্যাপক নির্যাতন চালায় আওয়ামী লীগ। এসব জুলুম, নিপীড়ন ও দাম্ভিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে গত বছর জুলাই মাসে। আন্দোলনকারীদের রাজাকার আখ্যায়িত করার সূত্র ধরে কোটা আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয় এবং শত শত মানুষের মৃত্যু, হাজার হাজার মানুষের গুরুতর আহত হয়ে অঙ্গহানি ও বিকলাঙ্গ হওয়ার ঘটনা ঘটে। কোটা আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। দাম্ভিক হাসিনার পতন হয়, তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পালানোর কয়েকদিন আগেও তিনি দম্ভভরে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালায় না, পালাতে জানে না’।
গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমনের চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে দাম্ভিক হাসিনাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেছে। এর মধ্য দিয়ে নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। এই দেশে অপকর্ম করে পার পাবে না কেউ। যত শক্তিশালীই হোক না কেন, এক দিন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। তাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গতকালের রায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ বিচার আগামী দিনের জন্য এক বার্তাও- বাংলাদেশ গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাবে। কোনো স্বৈরাচার আর কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে না। দিন শেষে জনতার বিজয় সুনিশ্চিত।
কেকে/এমএ