দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো ক্রমশ নিম্নমুখী। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি, নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলা এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি বাংলাদেশের বিনিয়োগ স্থবিরতা ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কারখানাগুলোয় গ্যাস সংকট ও ডলারের তারল্য সংকট। যার ফলে সাড়ে তিনশরও বেশি ছোট ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় এবং কর্মসংস্থান খাতে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র চাপ। এ দ্বিমুখী অস্থিতিশীলতার মধ্যেই রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের অর্থনীতিকে আরো ভঙ্গুর করে তুলছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশ আরো সংকটের মধ্যে পড়বে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- বর্তমানে বাংলাদেশে সুদের হার ১৪ শতাংশের ওপরে। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) খাতের ব্যবসায়ীরা মুনাফাই করেন ১০ থেকে ১১ শতাংশ। ফলে ব্যাংকঋণের বর্তমান সুদহার কোনো অবস্থায়ই ব্যবসাবান্ধব নয়। উচ্চ সুদহারে বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ মাসে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে মোট ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ জন শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এখন সময় এসেছে দেশের আর্থিক খাতকে পুনরুদ্ধার করতে সম্মিলীতভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার। আর এই পদক্ষেপের প্রথম ধাপ হলো দ্রুত সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। রাজনৈতিক স্থিতীশিলতা ছাড়া কোনো অর্থনৈতিক উদ্যোগই সফল হবে না। যদি রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত আলোচনায় না বসে এবং সংঘাতের পথ পরিহার না করে, তাহলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। নির্বাচনের আগে বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকি কেউ নিচ্ছে না। ট্রেজারি কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরলে বড় গ্রুপগুলো আবার নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ শুরু করবে। এতে এলসি খোলা বাড়বে ও আমদানির গতি ফিরবে। তাদের মতে, নির্বাচন শেষে নীতিগত দিকনির্দেশনা পরিষ্কার হলে অর্থনীতি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।
দেশের অর্থনীতি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার আইএমএফের ওয়েব সাইটে একটি বিবৃতিটি প্রকাশ করে- সেখানে আইএমএফের সুপারিশ হলো ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে হলে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে এবং বেসরকারি খাতের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে হবে।’ আর্থিক খাতের বর্তমান দুরবস্থা বিনিয়োগকে আরো নিরুৎসাহিত করছে। কর্মসংস্থান না হলে সমাজে অস্থিরতা বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন আইএমএফের পর্যবেক্ষক দল। ফেব্রুয়ারির ভেতর ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা না হলে বেসরকারি খাতে গতি ফিরবে না। রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে সময়মতো পণ্য ডেলিভারি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে ক্রেতাদের কাছে জরিমানা দিতে হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ক্রেতারা এখন বাংলাদেশকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ গন্তব্য’ হিসেবে বিবেচনা করে বিকল্প দেশে অর্ডার দিতে শুরু করেছেন। গত ছয় মাসে নতুন অর্ডার আসার হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমেছে। ফলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এবং আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দেশের শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে, যুব বেকারত্ব হ্রাস এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য বৃদ্ধির জন্য কাঠামোগত সংস্কারে গুরুত্ব দিয়ে একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। যাতে সামনের বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচক ঊর্ধ্বমুখী হয়।
কেকে/ আরআই