মানবসভ্যতার ইতিহাস প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক দ্বারা সংজ্ঞায়িত। লাখ লাখ বছর ধরে প্রকৃতি এক অপরিবর্তনীয়, শক্তিশালী এবং স্থিতিস্থাপক প্রতিরক্ষা প্রাচীর হিসেবে কাজ করেছে, যা আমাদের গ্রহের পরিবেশগত স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে, জলচক্র নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং রোগের বিস্তার সীমিত করে জীব জগৎকে সুরক্ষা দিয়েছে। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর থেকে মানবজাতির দ্রুত বিস্তার, লাগামহীন ভোগ এবং দূরদর্শিতার অভাব এই প্রতিরক্ষা প্রাচীরে গভীর ফাটল ধরিয়েছে। আজ আমরা এক এমন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে এই ভাঙন মানবজাতিকে এক দ্বিমুখী সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে : একপাশে জলবায়ু বিপর্যয়, অন্যপাশে অভূতপূর্ব মহামারির আশঙ্কা।
প্রকৃতির এই প্রতিরক্ষা প্রাচীর ভাঙার প্রধান কারণ হলো জীবাশ্ম জ্বালানির নির্বিচার ব্যবহার এবং পৃথিবীর মূল্যবান সম্পদগুলোর ওপর আমাদের ধারাবাহিক অত্যাচার। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই ধাক্কা প্রকৃতির সুপ্রাচীন ব্যবস্থার ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করছে যে, তার পক্ষে আর পরিবেশগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এই উষ্ণায়ন মেরু অঞ্চলের বরফ গলাচ্ছে, সমুদ্রের স্তর বাড়াচ্ছে এবং পৃথিবীর আবহাওয়ার ধরনকে আমূল পরিবর্তন করে দিচ্ছে। ফলস্বরূপ, আমরা সাক্ষী হচ্ছি আরো শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, প্রলয়ঙ্করী বন্যা, তীব্র খরা এবং দাবানলের, যা প্রকৃতির দেওয়া সতর্কবার্তা নয়, বরং তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সুস্পষ্ট পতনের ইঙ্গিত।
এ জলবায়ু বিপর্যয়ের ফল কেবল ভৌগোলিক বা পরিবেশগত ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; এর গভীর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব রয়েছে। বারবার আঘাত হানা প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা কেড়ে নিচ্ছে, কৃষি অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে এবং লাখ লাখ মানুষকে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত করছে। একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় এক মুহূর্তে একটি দেশের কয়েক দশকের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। অন্যদিকে, বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত ধরন খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলছে। যখন খাদ্যশস্যের উৎপাদন ব্যাহত হয়, তখন বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বাড়ে, যা বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য এক অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বহু-মাত্রিক প্রভাব সমাজের দুর্বলতম অংশকে আরো প্রান্তিক করে তুলছে, কারণ তাদের পক্ষে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা তুলনামূলকভাবে কঠিন।
জলবায়ু সংকটের পাশাপাশি, প্রকৃতির প্রতিরক্ষা প্রাচীর ভাঙার ফলস্বরূপ আমরা মহামারির এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি। এই প্রাচীরের একটি অপরিহার্য অংশ ছিল জীববৈচিত্র্য এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চলÑ যা মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর মধ্যে এক স্বাস্থ্যকর দূরত্ব বজায় রাখত। বন হলো প্রাণী এবং বিভিন্ন অণুজীবের প্রাকৃতিক গবেষণাগার, যেখানে ভারসাম্য বজায় থাকায় রোগ সৃষ্টিকারী প্যাথোজেনগুলো তাদের প্রাকৃতিক পোষকের (ঐড়ংঃ) মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু যখন আমরা দ্রুত গতিতে বন উজাড় করছি, তখন সেই বন্যপ্রাণীরা তাদের আবাসস্থল হারিয়ে লোকালয়ের কাছাকাছি আসতে বাধ্য হচ্ছে।
এই ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শের ফলে বন্যপ্রাণীদেহ থেকে মানুষে রোগ সঞ্চালনের (তড়ড়হড়ঃরপ ঝঢ়রষষড়াবৎ) ঘটনা বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের কোভিড-১৯ মহামারি এই বাস্তবতার এক ভয়াবহ প্রমাণ। এই বিপর্যয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, প্রকৃতির সীমানা লঙ্ঘন করার পরিণতি মানবজাতির জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে। একটি ক্ষুদ্র ভাইরাস এক মুহূর্তের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিকে স্থবির করে দিতে পারে, স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে পারে এবং কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে।
এ ছাড়াও, জলবায়ু পরিবর্তন সরাসরি রোগ বহনকারী জীবদের (ঠবপঃড়ৎং) বিস্তার বাড়িয়ে দিচ্ছে। উষ্ণ তাপমাত্রা মশা, এঁটেল পোকা এবং অন্যান্য বাহক জীবের প্রজনন এবং বেঁচে থাকার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। এর ফলে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, জিকা ভাইরাস বা চিকুনগুনিয়ার মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগগুলো নতুন নতুন শীতল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। বন্যা এবং সুপেয় জলের অভাবও জলবাহিত রোগ যেমন কলেরা বা টাইফয়েডের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে। এটি পরিষ্কার যে, জলবায়ু পরিবর্তন কেবল একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সংকটও বটে। প্রকৃতির প্রতিরক্ষা প্রাচীর ভাঙার এই প্রক্রিয়া মানব সমাজকে একদিকে যেমন পরিবেশগত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্ম দিচ্ছে।
এই দ্বিমুখী সংকটের মুখে মানবজাতির সামনে এখন একটাই পথ খোলা, তা হলো আত্মসমালোচনা এবং আশু পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রকৃতির এই ভাঙা প্রাচীরকে পুনর্নির্মাণ করতে হলে আমাদের বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রার মূলে পরিবর্তন আনতে হবে। এর প্রথম ধাপ হলো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করা এবং দ্রুত নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে সরে আসা। বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন এবং শিল্প খাতে কার্বন নিঃসরণকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে না পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের লাগাম টানা অসম্ভব।
দ্বিতীয়ত, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং বনভূমি রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। বনাঞ্চলকে কেবল অর্থনৈতিক সম্পদের উৎস হিসেবে দেখা বন্ধ করতে হবে, বরং তাকে পরিবেশগত ভারসাম্য এবং জনস্বাস্থ্যের রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ম্যানগ্রোভ বন, প্রবাল প্রাচীর এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রগুলোর সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে বিনিয়োগ করতে হবে, কারণ এগুলোই প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে কার্যকর ঢাল। পৃথিবীর অন্তত ৩০ শতাংশ স্থলভাগ ও জলভাগকে সুরক্ষিত অঞ্চলে পরিণত করার বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে।
তৃতীয়ত, জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ নীতিমালার মধ্যে একীকরণ ঘটাতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে মানবস্বাস্থ্য, পশুপাখির স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের স্বাস্থ্য একে অপরের সঙ্গে জড়িতÑ যা ‘ওয়ান হেলথ’ (ঙহব ঐবধষঃয) নীতির মূল কথা। মহামারি প্রতিরোধে প্রাথমিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, রোগ শনাক্তকরণের সক্ষমতা এবং দ্রুত টিকা উৎপাদনের গবেষণায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং পরিবেশ সংস্থাগুলোর মধ্যে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান এবং সমন্বিত কার্যক্রম জরুরি।
এই বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এককভাবে কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান সফল হতে পারবে না। এর জন্য প্রয়োজন ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার এক নতুন অধ্যায়। উন্নত দেশগুলোর উচিত তাদের ঐতিহাসিক কার্বন নিঃসরণের দায় স্বীকার করে জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় অর্থ এবং প্রযুক্তি সরবরাহ করা।
প্রকৃতির প্রতিরক্ষা প্রাচীর ভাঙার এই পরিণতি অনিবার্য ছিল, যখন মানবজাতি প্রকৃতিকে তার সেবাদানকারী হিসেবে না দেখে কেবল শোষণের বস্তু হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। এই সংকট আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা প্রকৃতির অংশ এবং প্রকৃতির ওপর আমাদের আধিপত্য ক্ষণস্থায়ী। মানবজাতির অস্তিত্ব এবং কল্যাণ এই গ্রহের সুস্থতার ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতির ভাঙা প্রাচীর মেরামত করা এবং তার সঙ্গে সহাবস্থান করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। এই উপ-সম্পাদকীয়ের মাধ্যমে আমরা সেই জরুরি আহ্বান জানাচ্ছি, আজই যদি আমরা সচেতন না হই, তবে জলবায়ু বিপর্যয় এবং মহামারির মিলিত শক্তি আমাদের ধ্বংসের পথে অনিবার্য করে তুলবে।
প্রকৃতির প্রতিরক্ষা প্রাচীর ভাঙার মাধ্যমে মানবজাতি জলবায়ু বিপর্যয় এবং মহামারির এক দ্বিমুখী সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এই বিপর্যয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের লাগামহীন উন্নয়ন এবং ভোগবাদিতার মূল্য কত ভয়াবহ হতে পারে। উষ্ণায়ন, চরম আবহাওয়া এবং জীববৈচিত্র্যের বিনাশ একদিকে পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে, অন্যদিকে বন্যপ্রাণী ও মানুষের মধ্যেকার সীমানা মুছে দিয়ে নতুন নতুন প্যাথোজেনের উত্থানের পথ প্রশস্ত করছে। কোভিড-১৯ এর মতো মহামারির অভিজ্ঞতা আমাদের স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, পরিবেশের ক্ষতি মানেই মানব স্বাস্থ্যের সরাসরি ঝুঁকি।
এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আর দেরি করা চলে না। আমাদের অবশ্যই জীবাশ্ম জ্বালানি ত্যাগ করে দ্রুত নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুঁকতে হবে এবং বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে দেখতে হবে। ‘ওয়ান হেলথ’ নীতির মাধ্যমে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্যকে অবিচ্ছেদ্য হিসেবে গণ্য করে সমন্বিত কৌশল তৈরি করা অত্যাবশ্যক। এই প্রাচীর মেরামত করা কেবল পরিবেশের জন্য নয়, বরং মানবজাতির নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জরুরি। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, প্রযুক্তিগত স্থানান্তর এবং ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার মাধ্যমেই আমরা ধ্বংসের পথ থেকে সরে এসে প্রকৃতির সঙ্গে সংহতির এক নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারি। প্রকৃতির সুরক্ষাই আমাদের চূড়ান্ত সুরক্ষা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
কেকে/ আরআই