যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন নতুন মোড় নিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে। এক সময় পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে ক্ষুব্ধ ট্রাম্প আজ সেই দেশটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শুধু প্রশংসাই নয়, নানাভাবে পাকিস্তানকে পুরোনো কৌশলগত অগ্রাধিকারের কেন্দ্রে তুলে আনার চেষ্টা করছে হোয়াইট হাউস।
এ পরিবর্তনের পেছনে ভূরাজনৈতিক হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত স্বার্থ, ব্যবসায়িক সম্পর্ক ও অতিরিক্ত প্রশংসা-নির্ভর কূটনীতি। এর ফলস্বরূপ ভারত -মার্কিন সম্পর্ক যে মারাত্মক চাপে পড়েছে, তা ক্রমেই প্রকাশ্য হয়ে উঠছে। ট্রাম্প ২০১৮ সালের শুরুতে পাকিস্তানকে নিয়ে তার ক্ষোভ ঝাড়েন এক টুইট বার্তায়- ১৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি সাহায্য দিয়েছে, এর বদলে পেয়েছে ‘মিথ্যা আর প্রতারণা’। এরপর তিনি পাকিস্তানের সামরিক সহায়তা স্থগিত করেছিলেন, কারণ সন্ত্রাসীদের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন এবং ওসামা বিন লাদেনকে দীর্ঘদিন গোপন রাখার প্রশ্ন তার চোখে ক্ষমার অযোগ্য ছিল।
কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই পাকিস্তানই ট্রাম্প প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, ইরানকে নিয়ন্ত্রণ এবং মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর ওপর চাপ বাড়াতে পাকিস্তানের সহায়তা প্রয়োজন। বাস্তবে পাকিস্তান অতীতে কখনোই নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা সহযোগী ছিল না। বরং আফগান তালেবান থেকে শুরু করে বিভিন্ন জঙ্গি নেটওয়ার্ককে আশ্রয়-সহায়তা দেওয়ার ইতিহাসই বেশি দীর্ঘ। ট্রাম্পের মনোভাবের এই নাটকীয় পরিবর্তনের আসল কারণ ভূরাজনীতি নয়-ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক স্বার্থ।
২০২৫ সালে পাকিস্তান যে চুক্তি করল ‘ওয়ার্ল্ড লিবার্টি ফিন্যান্সিয়াল’ নামের ক্রিপ্টো কোম্পানির সঙ্গে, সেটিই মোড় ঘুরিয়ে দিল। কোম্পানিটি মূলত ট্রাম্প পরিবার ও উইটকফ পরিবারের মালিকানাধীন। পাকিস্তানের এই বিনিয়োগ চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। কারণ রাষ্ট্রপতির ব্যবসায়িক স্বার্থ সরাসরি পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করছে- এমন অভিযোগ বহুদিনের, এবার তা আরো স্পষ্ট।
এর পর পরই যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাকিস্তান জানায়, যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর শুল্ক কমাবে এবং জ্বালানি, খনিজশিল্প, আইটি ও ক্রিপ্টো খাতে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়বে। এই ঘোষণাগুলো পাকিস্তানের জন্য শুধু অর্থনৈতিক সাফল্যই নয়- কূটনৈতিক বিজয়ও বটে।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো পাকিস্তানের ‘গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের’ গল্প। পাকিস্তান দাবি করছে, তাদের ভূগর্ভে ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজ ভান্ডার রয়েছে- যা যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করতে পারে। কিন্তু এসব অনুমান অধিকাংশই যাচাইবিহীন এবং খনিজের বড় অংশ অবস্থিত বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়ায়- যেখানে বিদ্রোহ ও সহিংসতা প্রতিদিনের ঘটনা। বহু বিশেষজ্ঞ ইতোমধ্যেই ঠাট্টা করে বলছেন, ‘পাকিস্তান বহুদিন ধরে সোনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, কিন্তু বাস্তবে দিচ্ছে নুড়িপাথর।’
তবুও পাকিস্তান বুঝেছে ট্রাম্পকে কীভাবে সন্তুষ্ট করতে হয়। সামরিক প্রধানকে নিয়ে ওভাল অফিসে গিয়ে ট্রাম্পকে তারা উপহার দিয়েছে পালিশ করা কাঠের বাক্সে সাজানো বিরল খনিজের নমুনা। এমন প্রতীকী উদ্যোগ, সঙ্গে অতিরিক্ত প্রশংসা- ট্রাম্পকে যে সহজেই প্রভাবিত করে, তা গত এক দশকেই বহুবার দেখা গেছে। পাকিস্তান এমনকি ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যও মনোনীত করেছে- যেটি ট্রাম্প বহুদিন ধরে প্রত্যাশা করে আসছেন।
এ তোষামোদ কাজে লেগেছে। পাকিস্তানের সামরিক প্রধানকে ট্রাম্প তার ‘প্রিয় ফিল্ড মার্শাল’ ঘোষণা করেছেন। পাকিস্তানও সুযোগ বুঝে সংবিধান সংশোধন করে সেনাপ্রধানকে কার্যত দেশের সর্বোচ্চ শাসকে উন্নীত করেছে, বেসামরিক সরকারকে নামমাত্র প্রতীকী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। এতসব নাটকীয় উন্নয়নে সবচেয়ে বিচলিত ভারত। দুই দশক ধরে ভারত-মার্কিন কৌশলগত অংশীদারত্ব গড়ে উঠছিল। যৌথ সামরিক সহযোগিতা, ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তা কাঠামো এবং চীনের প্রভাব মোকাবিলায় দুই দেশের সম্পর্ক ছিল অনন্য উচ্চতায়। সেই সম্পর্ক এখন গভীর সংকটে। ২০২৫ সালের মে মাসে ভারত-পাকিস্তান তিন দিনের সামরিক সংঘর্ষের পর যখন দুপক্ষ অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হলো, ট্রাম্প দাবি করেন তিনিই যুদ্ধ থামিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্যে তা অস্বীকার করেন- তিনি বলেন, ট্রাম্পের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগই হয়নি। কিন্তু ট্রাম্প নিজের গল্পেই অটল থাকেন, যা দেশে মোদির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে।
পরিস্থিতি আরো খারাপ হয় যখন ভারত ট্রাম্পের নোবেল আকাক্সক্ষায় সায় না দেয়। এর পর পরই যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, পরে তা বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করল- ভারতীয় বাজারে মার্কিন পণ্যের প্রবেশে বাধা রয়েছে এবং ভারত রাশিয়ার তেল আমদানি বাড়িয়েছে। ভারত এটিকে সরাসরি রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে দেখেছে পাকিস্তান ইস্যুতে কূটনৈতিক অস্বস্তিরই বহিঃপ্রকাশ।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান বা তুরস্ক রাশিয়ার বিপুল পরিমাণ জ্বালানি কিনলেও তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। এমনকি হাঙ্গেরি, যা ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ, ৯০% রাশিয়ান জ্বালানি আমদানি করেও ছাড় পেয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে- তাহলে ভারত কেন শাস্তির মুখে?
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রাতিষ্ঠানিক ধারাকে উপেক্ষা করে ট্রাম্পের এই ব্যক্তিনির্ভর কূটনীতি দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য বিপজ্জনক। ভারত-মার্কিন সম্পর্ক শুধু দুই দেশের জন্য নয়, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য রক্ষার জন্য অপরিহার্য। চীনের উত্থানের মোকাবিলায় যার গুরুত্ব অপরিসীম।
কিন্তু পাকিস্তানের প্রশংসা, অতিমাত্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত, ব্যবসায়িক সম্পর্ক এবং অবাস্তব খনিজ প্রতিশ্রুতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ট্রাম্প সেই অংশীদারত্বই ঝুঁকির মুখে ফেলছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতির এ পরিবর্তন ১৯৭০-এর দশকের মতোই সম্ভাব্য অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে- যখন ঠান্ডা যুদ্ধের স্বার্থে ওয়াশিংটন একইভাবে পাকিস্তানকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়েছিল।
ট্রাম্পের পাকিস্তানপ্রীতি আজ শুধু ভারতের কৌশলগত স্বার্থের ক্ষতি করছে না; বরং গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা, শক্তির ভারসাম্য এবং দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব প্রভাবকেও দুর্বল করছে। ইতিহাস বলে- স্বল্পমেয়াদি লাভ বা ব্যক্তিগত স্বার্থের ভিত্তিতে গড়া জোট টেকে না। এই সত্য বুঝতে না পারলে দক্ষিণ এশিয়া আবারো বিপজ্জনক অস্থিরতার মুখোমুখি হতে পারে।
লেখক : সংবাদকর্মী
কেকে/এমএ