বাংলাদেশের রাজনীতি এক ঐতিহাসিক বিষয়ের সন্ধিক্ষণে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষণায় স্পষ্ট হয়েছে যে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসাথে আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী, তবে একই সঙ্গে এটি রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আমি একজন প্রবাসী বাংলাদেশি। দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকায় পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ট্রাফিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কর্মরত থেকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৩ হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও মাতৃভূমির প্রতিটি রাজনৈতিক স্পন্দন অনুভব করি। তাই দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত আমার কাছে কেবল উপদেষ্টা পরিষদের প্রশাসনিক ঘোষণা নয় বরং দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য এই সিদ্ধান্ত এক বড় পরীক্ষা।
গত দেড় দশকে বাংলাদেশের রাজনীতি ফ্যাসিবাদের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ দ্বারা এমনভাবে একক ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছিল যে, বিগত দেড় যুগে এদেশের জনগণের কণ্ঠস্বর প্রায় হারিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নিজেদের উন্নয়ন-গাঁথার মুখস্থ এক রচনা আর অগ্রগতির আওয়ামী প্রচারণায় দেশটিকে একটি নিয়ন্ত্রিত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আওয়ামী সরকার কথায় কথায় উন্নয়ন, মতবিরোধ বা যেকোনো কাজেই দমননীতি প্রয়োগ এই দ্বৈত বাস্তবতা দেশের ভেতরে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক অসুস্থতা সৃষ্টি করেছিল। গণমাধ্যমে সেন্সরশিপ, ভিন্নমত দমন, আইসিটি আইনের বিরোধী দলের প্রতি অপপ্রয়োগ, আদালত ও প্রশাসনের দলীয়করণ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দলীয়করণ করাসহ সবকিছুতেই একদলীয় আধিপত্যের প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
অথচ এই দলই একসময় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বলত। সেই আদর্শের নাম নিয়ে ক্ষমতার চিরস্থায়িত্ব নিশ্চিত করার রাজনৈতিক প্রহসন করেছে। মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রকে লুণ্ঠিত করেছে। অবশেষে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৫ আগস্ট পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় থেকে শুরু করে সকল মন্ত্রী, এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং ইউনিয়নব্যাপি স্বচ্ছল সব নেতাকর্মীর একযুগে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস শুধু বাংলাদেশ নয় সারা পৃথিবীতে এমন ঘটনা ঘটে নি।
এই বাস্তবতায় প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা জুলাই সনদের জন্য “গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে হবে” প্রথম দেখায় জনমত যাচাইয়ের মতো মনে হলেও, আশঙ্কা থেকে যায়, এটি কি আবারও ক্ষমতা রক্ষার কৌশল? জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হলে শুধু তারিখ ঘোষণাই যথেষ্ট নয়, দরকার একটি নিরপেক্ষ ও বিশ্বস্ত পরিবেশ। কিন্তু আওয়ামী লীগ যেভাবে প্রশাসন ও স্থানীয় কাঠামোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে গেছে, সেখানে সেই স্বাধীনতা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ আছে।
তবে এর মধ্যেও আশা আছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশ যে রাজনৈতিক জাগরণ দেখেছে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। অরাজনৈতিক অনেক সাহসী তরুণ নেতৃত্ব, নাগরিক সমাজ এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপির উদীয়মান নেতৃত্ব যে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—বাংলাদেশে পরিবর্তনের সময় এসেছে। তারা আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দমননীতি ভেঙে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করতে সক্ষম হয়েছে। প্রবাসী সমাজ থেকেও এই পরিবর্তনের সুর পাওয়া যাচ্ছে। নিউইয়র্ক, লন্ডন, টরোন্টো থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত প্রবাসীরা এখন ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠে বলছেন—আমরা মুক্ত, স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন চাই। দেশের জন্য কল্যানকর সরকার চাই।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অনেকেই “শেষ সুযোগ” হিসেবে দেখছেন। যদি এই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, তাহলে দেশ আবারও আন্তর্জাতিক আস্থা ফিরে পাবে। যদি তা ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশ আরও গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঢুকে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক মহল এখন বাংলাদেশকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের প্রধান উদ্বেগ হলো, বাংলাদেশ কি গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরবে, নাকি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে অনুসরণ করে বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর মাধ্যমে একদলীয় শাসনের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি কিংবা জামায়াতের মাধ্যমে এদশে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থান ফিরে আসা নিয়ে সন্দেহ অমূলক নয়। কারণ আওয়ামী লীগের একদিকে দলের নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা তলানিতে অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় পার্টির মাধ্যমে দলটি তাদের পুরনো সাজানো প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ আবারও ধরে রাখার চেষ্টার প্রবণতা বেড়েছে।
লুটপাট করার জন্য বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সমঝোতার যে অর্থনৈতিক লেনদেনের গল্প শোনা যায় এবং জনমনে বলা হয় তার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ অসুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং ভয়াবহ দুর্নীতির বিস্তারের যোগসাজশ। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ছাড়া, আওয়ামী লীগকে মাইনাস করে একটি অবাধ, একতাবদ্ধ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহনমুলক নির্বাচনই হতে পারে দেশের রাজনীতির পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়া।
যেহেতু গোপনে এনসিপির সাথে বিএনপির একটা জোট গঠনের ও বোঝাপড়ার বিষয়টি আলোচনায় আছে এবং জামায়াতে ইসলামী অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর সাথে জোট বাধছে সেহেতু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি এবার সত্যিকার অর্থে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে বিএনপি এবং এনসিপি যৌথভাবে একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প শক্তিশালী সরকার গঠন করতে পারে এবং জামায়াতের নেতৃত্বে বিরোধী দল হতে পারে।
বিএনপির অতীত কিছু রাজনৈতিক ভুল থাকলেও, তাদের সংগঠনিক সক্ষমতা এবং জনগণের কাছে গ্রহনযোগ্যতা এবং ফ্যাসিবাদকে পতনের ক্ষেত্রে এই দলের ছাত্রদের এবং নেতাদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। জনগণ আওয়ামী লীগের একচেটিয়া শাসনের বিরুদ্ধে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং তারা অবশ্যই দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এর আমুল পরিবর্তন দেখতে চায়। বিএনপির জন্য এটাই বিশাল সুযোগ, নিজেদের নবায়ন করে জাতির আস্থা পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমে দেশ পরিচালনার এই অবারিত সুযোগ গ্রহণ করা।
জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে, তবে বাস্তবতা হলো—তাদের একটি শক্ত ভোটব্যাংক রয়েছে। যদি তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অংশ নেয় এবং অতীতের বিতর্কিত অবস্থান থেকে সরে আসে, তবে একটি কার্যকর শক্তিশালী বিরোধী জোট রাজনীতির অংশ হতে পারে। বিএনপি যদি এনসিপি ও অন্যান্য নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যৌথ রূপরেখা তৈরি করে, তাহলে আওয়ামী লীগের এদেশে প্রত্যাবর্তন করা এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। আমেরিকা আওয়ামী লীগ আমলে একাধিকবার নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল, ভিসা নীতি প্রয়োগ করেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছিল। আওয়ামী লীগের ভারতের ওপর অতিনির্ভরতা ও চীনের সঙ্গে লেনদেনের অস্পষ্টতা দেশকে একটি “অস্থির কূটনৈতিক ভারসাম্যহীনতার” দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে হলে সরকারের পরিবর্তনই একমাত্র পথ। দেশের এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপিই হতে পারে আস্থার স্থান।
বাংলাদেশকে যদি আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের আস্থায় ফিরিয়ে আনতে হয়, তবে দরকার স্বচ্ছ নির্বাচন, মানবাধিকার পুনরুদ্ধার, ও মুক্ত গণমাধ্যম। এনসিপি ও বিএনপি জোটবদ্ধ হয়ে যদি এই তিনটি অঙ্গীকার নিয়ে একসাথে এগোয় এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারে তবে বিদেশি বিনিয়োগ, বাণিজ্য সুযোগ, এবং কূটনৈতিক সমর্থন সহজেই পাওয়া যাবে।
আমি আমেরিকায় পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে দেখি—একটি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা কতটা শক্তিশালী হয় যখন রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিগুলো সৎ থাকে। বাংলাদেশের জন্যও এখন সময় এসেছে নৈতিক রাজনীতি করার। গণভোটের মাধ্যমে যদি জনগণ আসলেই মতামত দিতে পারে—কে কোন পথে দেশ চালাতে চায় তাহলে এটি হতে পারে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনর্জাগরণের সূচনা। কিন্তু যদি এই গণভোটও ক্ষমতার নতুন ছদ্মবেশে পরিণত হয়, তাহলে জনগণের আস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।
আজকের বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ ক্লান্ত—দলীয় বিভাজন, অতীতের ভয়াবহ দুর্নীতি, লুটপাট ও অন্যায়ের শাসনে তারা আশাহত। তারা এখন শুধু ন্যায় ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য দরকার এক নতুন নেতৃত্ব, যে ক্ষমতার জন্য নয়, দেশের জন্য কাজ করবে। আওয়ামী লীগের দমননীতির বিপরীতে বিএনপি, এনসিপি ও জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া সাহসী নেতৃত্বগুলো সেই পরিবর্তনের আবাস দিচ্ছে। গণভোট ও নির্বাচনের দিনটি যেন ক্ষমতার পুনর্দখলের দিন না হয়ে গণতন্ত্রের পুনর্জন্মের দিন হয়।
লেখক : অফিসার, নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, যুক্তরাষ্ট্র
কেকে/ আরআই