রাজধানীর শাহবাগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড, জলকামান ও লাঠিচার্জের ঘটনা শুধু দুঃখজনকই নয়, বরং রাষ্ট্র আমাদের দেশের শিক্ষকদের যে একটি কাঠামোগত অবহেলার মধ্যে রেখেছে এবং রাখতে চাচ্ছে তারই বহিঃপ্রকাশ। এ আক্রমণের প্রতিবাদে এবং তিন দফা দাবি বাস্তবায়নে শিক্ষকরা দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গতকাল রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি শুরু করেছেন। ফলে সারা দেশের প্রায় ৬৫ হাজার বিদ্যালয়ে ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষা সভ্যতার ভিত্তি তৈরি করে, আর শিক্ষক সেই ভিত্তির নির্মাতা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রের ফ্রন্টলাইনার। তারাই শিশুর ভেতর সুবোধ ও সু চেতনার জাগরণ ঘটাতে পারে। সেই নির্মাতাদেরই যখন দাবি আদায়ের পথে সহিংসতা ও অপমানের শিকার হতে হয়, তখন প্রশ্ন জাগে-আমরা কোন পথে চলছি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে বেতন বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন। তাদের মূল দাবি-দশম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ, দীর্ঘদিনের পদোন্নতির জটিলতা নিরসন এবং শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতির বাস্তবায়ন। এ দাবিগুলো অযৌক্তিক নয়। একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তা বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উচ্চতর গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন, অথচ প্রাথমিকের শিক্ষকরা এখনো ১৩তম গ্রেডে রয়েছেন-এটি নিঃসন্দেহে বৈষম্যমূলক।
কিন্তু এ বৈষম্য নিরসনের পথে সংলাপ ও সমাধান খোঁজার পরিবর্তে পুলিশি দমন-তা এক অদূরদর্শী পদক্ষেপ। শিক্ষকদের ওপর জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহারের ঘটনা মানবিক ও প্রশাসনিক উভয়দিক থেকেই অগ্রহণযোগ্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা বাহিনী যদি আন্দোলন দমনেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অন্যদিকে সরকারপক্ষ বলছে, আন্দোলনকারীরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছুড়েছেন, ব্যারিকেড ভেঙেছেন। এমন কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার অজুহাতে শতাধিক শিক্ষককে আহত করা ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। বরং, তা সরকারের প্রতি জনমনে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করে। এ আন্দোলনটি চলছে এমন একটি সময়ে যখন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সন্নিকটে, নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনাও বেড়ে চলছে ক্রমশ। এমন প্রেক্ষাপটে পেশাজীবী গোষ্ঠীর ন্যায্য আন্দোলনকে বলপ্রয়োগে থামানো হলে তা আরো অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। বরং সরকারের উচিত দ্রুত আলোচনায় বসে শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি সমাধানের পথ বের করা।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা তিন কোটি শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ার মূল স্তম্ভ। সেই স্তম্ভে থাকা শিক্ষকরা যদি বঞ্চনা ও হতাশায় ভোগেন, তবে শিক্ষার মান রক্ষা করা সম্ভব নয়। বৈশ্বিক মান বিবেচনায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক পিছিয়ে আছে। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত এ মুহূর্তে শিক্ষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে সহানুভূতিশীল ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়া আলোচনার পথ তৈরি করা যাতে শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে ফিরে যেতে পারেন এবং তাদের সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকে।
কেকে/এআর