বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, যা ১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. মহসিন মিয়া। তার দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে ব্যাংকের আমানত, হিসাবধারীর সংখ্যা, বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স প্রবাহ, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং খেলাপি ঋণ আদায়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খোলা কাগজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আলতাফ হোসেন।
খোলা কাগজ : বর্তমান ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
মহসিন মিয়া : বর্তমান ব্যাংক খাত নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা ব্যাংকের দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছি। গ্রাহকের সমস্যা দ্রুত সমাধান করা এবং সেবার মান উন্নয়নের দিকে পুরো পর্ষদ মনোযোগী। ট্রেড অপারেশন অটোমেশন, করপোরেট ব্যাংকিংয়ে নতুন সেবার সংযোজন এবং নিরাপদ ও নির্ভুল সেবা নিশ্চিত করার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য গ্রাহকের অভিজ্ঞতা আরো উন্নত করা।
খোলা কাগজ : গ্রাহকের আস্থা ও ব্যাংকের সাফল্যের মূল কারণ কী?
মহসিন মিয়া : গত ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর অনেক ব্যাংকই গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে হিমশিম খেয়েছে আবার অনেক ব্যাংক গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারেনি। সেখানে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক থেকে কোনো গ্রাহককে টাকা না নিয়ে ফেরত যেতে হয়নি, যা গ্রাহকের আস্থা বৃদ্ধি করেছে। ফলে আমানত ও গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে। মাত্র আট মাসে ৭৭১ কোটি টাকারও বেশি আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে ৬০ হাজারের বেশি। শতভাগ সুশাসন এবং আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের সাফল্যের মূল ভিত্তি। এই আস্থা ব্যাংককে আরো দূর এগোতে প্রেরণা দিচ্ছে।
খোলা কাগজ : বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের পণ্য, সেবা এবং কর্মকর্তাদের দক্ষতা সম্পর্কে চানতে চাই?
মহসিন মিয়া : বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের পণ্য ও সেবার গুণমান অত্যন্ত উচ্চমানের। ব্যাংকে একদল মেধাবী কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা নতুন উদ্ভাবনী পণ্য এবং সেবা দিতে সক্ষম। এ ছাড়া অনুপ্রাণিত এবং উদ্যোমী কর্মকর্তারা নতুন ব্যবসা অর্জনে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। দক্ষ পরিচালনা পর্ষদ করপোরেট সুশাসন বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
খোলা কাগজ : ব্যাংকের বর্তমান আর্থিক অবস্থা এবং গ্রাহকের নিরাপত্তা কেমন?
মহসিন মিয়া : বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের অর্ধেক মালিকানা সরকারের, তাই গ্রাহকের আমানত শতভাগ নিরাপদ। বর্তমানে ব্যাংকের ১০৭টি শাখা রয়েছে এবং মোট আমানতের পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছরের আর্থিক সূচক দেখে বোঝা যায় ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার ধারাবাহিক উন্নতি হচ্ছে।
খোলা কাগজ : প্রান্তিক মানুষের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ দিতে অন্যান্য ব্যাংক তেমন আগ্রহ দেখায় না। আপনার ব্যাংকের অবস্থা কী?
মহসিন মিয়া : বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতে ঋণ বিতরণে বেশি উদ্যোগ নিচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই উদ্যোক্তাদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ঋণ প্রদান করি এবং ভালো ব্যবসায়ীদের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। সব করপোরেটকে ঋণ দেই না; বোঝাপড়া ও ঝুঁকি বিবেচনা করে সচেতনভাবে ঋণ বিতরণ করি। ছোট ব্যাংক হিসেবে আমাদেরকে সাবধানে চলতে হয়, কারণ একবার হোঁচট খেলে সমস্যা হতে পারে।
খোলা কাগজ : খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি এখন কী অবস্থায়?
মহসিন মিয়া : খেলাপি ঋণ আদায়ে আমরা সর্বোচ্চ জোর দিচ্ছি। যদিও খেলাপি ঋণ আদায়ে কিছু আইনি জটিলতা রয়েছে, যা ভাঙতে সময় লাগে, তবুও আমরা ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছি। বর্তমানে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সামান্য বেশি হলেও, বর্তমান বোর্ড দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে নতুন কোনো ঋণের কারণে তা বৃদ্ধি পায়নি। ব্যাংকের খেলাপি ঋণগুলো মূলত পুরোনো ঋণ।
খোলা কাগজ : বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক কীভাবে ডিজিটাল ব্যাংকিং উন্নয়নে কাজ করছে এবং এটি গ্রাহকদের জন্য কী সুবিধা নিয়ে এসেছে?
মহসিন মিয়া : আমরা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ব্যাংকিং সেবাকে গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। বিশেষ করে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের দিকে বেশি জোর দিচ্ছি, কারণ এটি গ্রাহকের কাছে দ্রুত ও সহজভাবে সেবা পৌঁছে দেয়। বর্তমানে গ্রাহকেরা ঘরে বসে ব্যাংকিং করতে বেশি পছন্দ করছেন, যা সরাসরি শাখা বা উপ-শাখার মাধ্যমে সম্ভব নয়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারি এবং গ্রাহকের অভিজ্ঞতাকে আরো সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলা সম্ভব। এ ছাড়া এটি ব্যয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়। বাস্তবে, যে ব্যাংকের ডিজিটাল সক্ষমতা যত বেশি, সেটি তত দ্রুত উন্নতি এবং সম্প্রসারণ করতে পারছে। সুতরাং ডিজিটাল ব্যাংকিং এখন শুধু একটি বিকল্প নয়, বরং আধুনিক ব্যাংকিংয়ের একটি মূল হাতিয়ার, যা গ্রাহক সেবা উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যয় ও সময় উভয়ই সাশ্রয় করছে।
খোলা কাগজ : ব্যাংক কোন ধরনের ঋণে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে?
খোলা কাগজ : বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক করপোরেট ঋণের পাশাপাশি সিএমএসএমই এবং সুরক্ষিত রিটেল ঋণে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, যেমন- হোম লোন, কার লোন এবং গ্রামীণ গৃহ ঋণ। আমাদের ব্যাংকের বেশকিছু উন্নত এবং কার্যকর প্রোডাক্ট রয়েছে, যা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা সক্রিয়ভাবে কাজ করছি। আমাদের লক্ষ্য শুধু ঋণ দেওয়া নয়, বরং মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সক্রিয়তায় অবদান রাখা। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঋণ প্রদানের সক্ষমতা যথেষ্ট শক্তিশালী এবং আমরা সেই সক্ষমতাকে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগাতে চাই। এ ছাড়া আমরা আমদানি ও রপ্তানিতে বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছি এবং রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতেও মনোযোগী। এ সব উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা দেশের অর্থনীতিকে আরো গতিশীল এবং প্রগতিশীল করতে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে ১২টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। সেই হিসেবে বর্তমান নতুন পর্ষদে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. আতাউর রহমান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব কামরুল হক মারুফ, জনতা ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম মর্তুজা এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট শেখ আশ্বাফুজ্জামান। এ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে রয়েছেন মোহাম্মদ জিয়াউল করিম।
কেকে/এআর