পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার বলরামপুর ইউনিয়নে সুদের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। স্থানীয় চামেশ্বরী গ্রামের শক্তিপদ রায় নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অতি সুদে টাকা ধার দিয়ে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়া, পরে সেটির অপব্যবহার করে মামলা করা ও জিনিসপত্র জোরপূর্বক আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, শক্তিপদ রায় চামেশ্বরী এলাকার মৃত জতিন্দ্রনাথ রায়ের ছেলে। তিনি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার দেবীপুর মোলানী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ২০২৪ সালে চাকরি থেকে অবসরে গেছেন।
ত্রিশুলিয়া গ্রামের ভ্যানচালক হাফিজুল ইসলাম জানান, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে তিনি শক্তিপদ রায়ের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার নেন। শর্ত ছিল প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা সুদ দিতে হবে। এভাবে টানা ১০ মাস তিনি মোট ৫০ হাজার টাকা সুদ পরিশোধ করেন। পরে তিনি সুদ দেওয়া বন্ধ করে শুধু মূল টাকা দিতে চান এবং কিছু সময় চান ফেরতের জন্য।
হাফিজুল বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, আমি আসল টাকা একসাথে দেবো, একটু সময় দেন। কিন্তু ১২ অক্টোবর শক্তিপদ রায় আমার ভ্যান ভাড়া নেয় গ্যাস সিলিন্ডার বাজারে নেওয়ার জন্য। ভ্যান নিয়ে তার বাড়িতে গেলে সে ভ্যান তালা মেরে দেয়। বলে সুদ-আসলসহ সব টাকা একসাথে না দিলে ভ্যান পাবেন না।’
এরপর হাফিজুল ভ্যান ফেরত পেতে স্ত্রীসহ গত ১৩ অক্টোবর বিকাল সাড়ে চারটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বলরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের সামনে অনশন করেন। খবর পেয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও দুই ওয়ার্ড সদস্যের সহযোগিতায় তার ভ্যান উদ্ধার হয়।
হাফিজুলের মতো একইভাবে প্রতারিত হয়েছেন চামেশ্বরী এলাকার আরও অনেকেই।
স্থানীয় প্রদীপ চন্দ্র রায় বলেন, ‘এক বছর আগে আমি শক্তিপদ রায়ের কাছ থেকে আমার ভাতিজার জন্য ৩০ হাজার টাকা নিয়েছিলাম। হাজারে ২০০ টাকা হারে মাসে ৬ হাজার টাকা করে সুদ দিতাম। কিছু দিন পরে আমার ভাতিজা আর সুদের টাকা দিতে না পারলে শক্তিপদ রায় ফাঁকা স্ট্যাম্পে নেওয়া স্বাক্ষর ব্যবহার করে কোর্টে পাঁচ লাখ টাকার মামলা করে।’
একই এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি ২০ হাজার টাকা নিয়েছিলাম, মাসে দুই হাজার করে ৯ মাসে ১৮ হাজার টাকা সুদ দিয়েছি। টাকা দেওয়ার সময় সে জোর করে ফাঁকা স্ট্যাম্পে সই নেয়। শুধু আমি না, আমাদের গ্রামের ৭০-৮০ জন লোকের কাছ থেকে এভাবে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়েছে।’
স্থানীয় কামরুল হাসান নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘শক্তিপদ রায়ের সুদের টাকা দেওয়ার সময় জোর করে ফাঁকা স্ট্যাম্পে সাক্ষর নেয়। পরে সেই স্ট্যাম্প ব্যবহার করে মামলা বা ভয়ভীতি দেখায়। আমরা প্রশাসনের কাছে দাবি জানাই, তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক।’
এ বিষয়ে শক্তিপদ রায় বলেন, ‘আমার কাছে হাফিজুল ভ্যান কেনার জন্য ৫০ হাজার টাকা ধার করে নিয়েছে এক মাসের জন্য। টাকা দেয় না- এ জন্য ভ্যান আটকে রেখেছি। আর প্রদীপ স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে এক সপ্তাহের জন্য পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছে। টাকা দেয় না- এ জন্য কোর্টে মামলা করেছি। আমি সুদের ব্যবসায় করিনা এবং কারও কাছ থেকে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিই নাই।’
বলরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আইনুল ইসলাম বলেন, ‘হাফিজুলের ভ্যান আটকে রাখার খবর পেয়ে আমরা চেয়ারম্যানের নির্দেশে ঘটনাস্থলে যাই। পরে আলোচনা করে ভ্যানটি তার হাতে তুলে দেই। এলাকার আরও কয়েকজনও শক্তিপদ রায়ের কাছে সুদের ফাঁদে পড়েছেন বলে শুনেছি।’
বলরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি ঘটনাস্থলে যাই। বিষয়টি দেখে মনে হয়েছে- হাফিজুলের প্রতি অন্যায় হয়েছে। আমরা ওয়ার্ড সদস্যদের সহযোগিতায় তার ভ্যানটি উদ্ধার করে দিই।’
‘এ ধরনের সুদের কারবার গ্রামাঞ্চলে ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। অনেক দরিদ্র মানুষ কষ্টের টাকায় সুদ দিতে দিতে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে।’
আটোয়ারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে এবং তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কেকে/ এমএ