বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫,
১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: ধর্মের অপব্যাখ্যা করে বিশৃঙ্খলা তৈরির সুযোগ দেয়া হবে না : ধর্ম উপদেষ্টা      ডেঙ্গুতে মৃত্যু আরও সাত, হাসপাতালে ভর্তি ৫৬৭      ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফের ভূমিকম্প      দুদকের সব কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক সম্পত্তির হিসাব দিতে হবে      প্রাথমিক শিক্ষকদের লাগাতার কর্মবিরতি      নির্বাচনী জোটের আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে : রাশেদ খান      গণতন্ত্র ফেরাতে নির্বাচনের বিকল্প নেই : আমান      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
একের পর এক কারখানা বন্ধ, টালমাটাল দেশের অর্থনীতি
প্রজ্ঞা দাস
প্রকাশ: শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৫, ১১:০৭ এএম আপডেট: ০৮.১১.২০২৫ ১১:১১ এএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বৃহৎ মাধ্যম হলো পোশাকশিল্প এবং উৎপাদনশীল কলকারখানা। এ শিল্পগুলো শুধু যে রপ্তানির চাকাকে সচল রাখে সেটাই নয় বরং দেশের গ্রামীণ নারী-পুরুষ শ্রমিকদের জীবিকার ব্যবস্থা করে, নগরীর মেট্রোপলিটন ও বন্দরনগরীর কর্মসংস্থানের উৎস এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চেইনের প্রবাহ ঠিক রাখে। কিন্তু বর্তমান সময়ে অর্থনীতির এ মেরুদণ্ড ভয়াবহ সংকটে আবদ্ধ। 

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব, ব্যাংক ঋণের জটিলতা, বৈদেশিক ক্রেতাদের কার্যাদেশ কমে যাওয়া, এলসি জটিলতা এবং শ্রমিক অসন্তোষ সব মিলিয়ে শিল্প খাত এখন বেসামাল অবস্থায় রয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছড়িয়ে পড়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, যা শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটিয়ে এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্ম দিয়েছিল, তা কেবল রাজনৈতিক পট পরিবর্তনই করে নাই বরং সমাজ, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই বড় একটি বাক বদল হয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলো আওয়ামী লীগের নেতা বা আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট। ৫ আগস্টের পর অনেক মালিকই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কার প্রতিষ্ঠান দখল হয়ে গেছে এই অস্থিতিশীল প্রতিবেশের ধারাবাহিকতায় পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়া, ফার্নিচার ও অন্যান্য উৎপাদনমুখী কারখানাগুলো আকস্মিকভাবে বন্ধে হতে থাকে। 

অভ্যুত্থানকালীন প্রায় ১০০টিরও বেশি কারখানা লুটপাট এবং আগুনের শিকার হয়, যার মধ্যে পোশাকশিল্প ছিল ৬০টিরও বেশি। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, এ ধ্বংসে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এটি ছিল শুধু প্রারম্ভিক আঘাত। 

অভ্যুত্থানের পরের মাসগুলিতে অর্থাৎ আগস্ট থেকে অক্টোবর ২০২৪ পর্যন্ত শ্রমিকদের অসন্তোষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরবরাহ চেইনের বিঘ্নের কারণে আরও ৩০০টিরও বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে পৌঁছে এই সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে ৭০ শতাংশই খোদ পোশাকশিল্পের। এভাবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবার ফলে প্রায় ৫ লাখ শ্রমিক চাকুরিচুত্য হয়, যা বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ১.৫ শতাংশের সমান। এখনেই শেষ নয়। অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও ভয় সৃষ্টি করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা, যারা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৬০ শতাংশ গ্রহণ করত,তারা বাংলাদেশের এ অস্থিরতা দেখে ধীরে ধীরে অর্ডার কমিয়ে দেয়। যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও বড় ধাক্কার মুখোমুখি হয়।

ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউটিও) সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আরএমজি (রেডি-মেড গার্মেন্টস) রপ্তানি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১২ শতাংশ কমেছে, যা ৪২ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে এসেছে ৩৭ বিলিয়ন ডলারে। এটি শুধু সংখ্যা নয়, বরং একটি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। কেননা বাংলাদেশের অর্থনীতির ১১ শতাংশ জিডিপি এবং ৮৪ শতাংশ রপ্তানি আয় পোশাকশিল্প থেকে আসে এবং এই শিল্পে ৪.৪ মিলিয়ন শ্রমিক নিয়োজিত, যাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী। এই একটা বিশাল অংশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এর পাশাপাশি এ সময়ে প্রচুর পরিমাণে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের কারখানাগুলোতে শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে, যা উৎপাদনকে আরো ধীরগতি করে দেয়। এতে মালিকপক্ষ এবং শ্রমিক পক্ষ উভয়ের মাঝে এক বিশাল দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। ফলে বেশ কিছু মালিক তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। 

বিজিএমইএর তথ্যানুসারে, সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ এককালীন ১৫০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, যা অক্টোবরে বেড়ে ২০০ ছাড়িয়েছে। যদিও এই বন্ধের পেছনে কারণগুলি ছিল বহুমুখী। প্রথমত, সরবরাহ চেইনের বিঘ্ন, অভ্যুত্থানকালীন লুটপাটে কাঁচামালের গুদাম ধ্বংস হওয়া, এবং ডলার সংকটে আমদানি ব্যাহত হওয়া । তা ছাড়াও এ সময়ে গ্যাস এবং বিদ্যুতের ঘাটতিও প্রকট রূপে দেখা দেয় যার ফলে কারখানাগুলি দৈনিক ৮ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার এ সময়ে বিভিন্নভাবে দুর্যোগপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দিতেও বেশ বেগ পান। এর মধ্যে আবার বিভিন্ন শ্রমিক অসন্তোষ, শ্রমিক মালিক দ্বন্দ্ব বিভিন্ন জার্নালে এমন হাইলাইট করে প্রকাশ করা হয় যার ফলে ইউরোপীয় ক্রেতাদের আরো দূরে সরিয়ে নেয়। ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার মতো প্রতিযোগী দেশগুলো এই ফাঁকা জায়গা দখল করে নেয়। 

পোশাকশিল্পের পাশাপাশি অন্যান্য উৎপাদনমুখী খাতগুলোও একই সংকটের শিকার হয়। টেক্সটাইল শিল্পে ২০২৪-এর চতুর্থ ত্রৈমাসিকে ১৫০টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে ১ লক্ষ শ্রমিকের চাকরি যায়। চামড়া শিল্পেও অভ্যুত্থানের পর পরিবেশগত নিয়মকানুনের কঠোরতায় এবং রপ্তানি হ্রাসে ৮০টি কারখানা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। ফার্নিচার এবং সিরামিকের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। গ্যাস সংকট এবং শ্রমিকের অভাবে ঢাকার আশপাশের ১০০টিরও বেশি সিরামিক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে বেকারত্ব বাড়ে এবং এর প্রভাব নারীদের ওপর বেশি পড়ে। এভাবে চলতে থাকলে এই বেকারত্বের সংখ্যা দিনে দিনে আরো বাড়বে। যা লৈঙ্গিক অসমতাকেও আরো গভীর করবে। এ কারখানা বন্ধের প্রভাব কেবল স্থানীয় নয়, বরং জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক। ২০২৫ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জে ডিএকেএক্স ইনডেক্স ১৫ শতাংশ কমেছে; যা সত্যিই দুঃখজনক। এ ধ্বংসের চক্র যদি না ভাঙে, তবে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে নেমে আসতে পারে বলেই বিজ্ঞজনের আশঙ্কা। 

কিন্তু এ অন্ধকারের মধ্যেও এখনো আলোর রেখা আছে। এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। তার জন্য এখনই শ্রমিক মহল এবং শিল্পপতিদের সঙ্গে আলাদাভাবে বসতে হবে। তাদের উভয়েরই সমস্যা শুনতে হবে। প্রয়োজনে তাদের অল্প সুদে লোনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তাদের অভয় দিতে হবে এবং উভয়েরই জানমালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশি আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য যা কিছু করা লাগে তার সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ডিজিটালাইজেশন আনতে হবে। বাণিজ্য এবং অর্থনীতির স্বার্থে হলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডে যে ফাটলগুলো দেখা দিয়েছে- এগুলো কেবল কারখানার দরজা বন্ধ করেনি, এটি একটি জাতির স্বপ্নকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের আগুন যদি পরিবর্তনের বীজ বপন করে থাকে, তাহলে আজ সবকিছু পূর্বের তুলনায় আরো ভালোভাবে পরিচালনার মাধ্যমে সেই বীজ থেকে ফসল উৎপাদন করতে হবে। তবেই, জুলাই অভ্যুত্থানের আসল সফলতা অর্জিত হবে। 

লেখক : তরুণ কলাম লেখক

কেকে/এমএ
আরও সংবাদ   বিষয়:  কারখানা বন্ধ   টালমাটাল   অর্থনীতি   প্রজ্ঞা দাস  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

চুয়াডাঙ্গায় বীজ বিক্রিতে অনিয়মের দায়ে দুই প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
শ্রীপুরে ইভটিজিং ইস্যুকে কেন্দ্র করে স্কুলছাত্রের ছুরিকাঘাত, আহত ৬
শেখ হাসিনার আইনজীবী হিসেবে না লড়ার সিদ্ধান্ত জেডআই খান পান্নার
দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা শ্রীমঙ্গলে ১২.৫ ডিগ্রি
মোহনপুরে বিএসটিআই লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা

সর্বাধিক পঠিত

ইয়ুথ ফোরামের নবনির্বাচিত কমিটিকে ব্যারিস্টার খোকনের বরণ
পাটগ্রাম উপজেলায় সীমান্ত সুরক্ষা জোরদারে 'চতুরবাড়ী বিওপি'র যাত্রা
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফের ভূমিকম্প
নাগেশ্বরীতে ১০ টাকার স্বাস্থ্য সেবা চালু
দুই ট্রলারসহ সেন্টমার্টিনে ১২ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close