একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার শিশুদের ওপর। শিশুদের মন, দেহ ও আত্মার বিকাশ—এই তিনটি মিলেই গড়ে ওঠে পূর্ণাঙ্গ মানুষ। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষাকে কেবল পরীক্ষার নম্বর, গ্রেড ও চাকরি পাওয়ার উপায় হিসেবে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর একটি গভীর প্রভাব ফেলেছে, যা কেবল শিক্ষার লক্ষ্যকে সংকীর্ণ করে দেয়নি, বরং শিশুর সৃজনশীলতা, মানবিকতা ও শারীরিক সুস্থতাকেও প্রভাবিত করছে।
শিশুরা তখনই প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত হয় যখন তারা আনন্দের সঙ্গে শেখে, গায়, খেলে এবং নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। শিক্ষার মধ্যে যদি আনন্দ না থাকে, শিশুদের মধ্যে উৎসাহ ও কৌতূহলও হারিয়ে যায়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আজ সেই আনন্দকে নস্যাৎ করছে। শিক্ষা যেন শুধুই বই মুখস্থ করা, পরীক্ষায় ভালো ফল করা এবং সামাজিক মর্যাদা অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই দৃষ্টিভঙ্গি শিশুর সৃজনশীল মনকে হত্যা করে, তাদের আবেগ ও মানবিক বিকাশকে উপেক্ষা করে।
সংগীত শিক্ষার গুরুত্ব শুধু বিনোদন বা কল্পনাশক্তির জন্য নয়। এটি শিশুদের আবেগ, মননশীলতা, এবং সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়। গবেষণায় দেখা গেছে, সংগীত শেখা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশকে সমৃদ্ধ করে, স্মৃতি শক্তি বাড়ায়, মনোযোগ বাড়ায় এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে। সংগীত শিক্ষার মাধ্যমে শিশু শিখে সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা, এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ। এটি তাদের মনকে মুক্ত করে এবং সৃজনশীল চিন্তার উন্নয়ন ঘটায়। কিন্তু আমাদের দেশে শিশুরা এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শারীরিক শিক্ষাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধুলা কেবল শারীরিক শক্তি বাড়ায় না; এটি শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব, দলগত চেতনা এবং সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। শিশু মাঠে দৌড়ালে, দলগত খেলা খেললে তারা জয়-পরাজয়, পরিশ্রম এবং সহযোগিতা শেখে।
আজকের বাস্তবতায় আমরা দেখি, শিশুরা মোবাইল ও কম্পিউটারের পর্দার মধ্যে বন্দি হয়ে পড়ছে। মাঠ ফাঁকা, দৌড়ানো কমছে, খেলাধুলার অভ্যাস হারিয়ে যাচ্ছে। যে জাতির শিশুরা খেলাধুলার আনন্দ হারায়, সেই জাতি ভবিষ্যতে উদ্যম, নেতৃত্ব ও মানসিক শক্তি হারায়। সরকারের যুক্তিÑ পরিকল্পনাটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল, বাস্তবায়নে অসমতা সৃষ্টি হতো—কেবল প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ। কিন্তু কোনো পরিকল্পনার ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করা যায়, বাতিল করা নয়। শিক্ষানীতিকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যা শিশুদের সার্বিক বিকাশকে প্রাধান্য দেয়। আমরা সেই সুযোগ হারিয়ে ফেলেছি। শিশুরা আজ কেবল যান্ত্রিক ও একঘেয়ে শিক্ষার মধ্যে বন্দি। তাদের হাতে বই ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মন, হৃদয় এবং দেহের বিকাশকে অবহেলা করা হয়েছে।
শিশুরা যখন সংগীত শেখে, নাটকে অংশ নেয়, মাঠে খেলে, তখন তারা কেবল নিজের প্রতিভা নয়, মানবিক ও সামাজিক গুণাবলিও বিকাশ করে। সার্বিক শিক্ষা বা ‘হলিস্টিক এডুকেশন’ বিশ্বজুড়ে এখন জাতীয় শিক্ষানীতির অংশ। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা এখনো সেই দরজায় পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শিক্ষাকে কেবল ফলাফলের সঙ্গে সীমাবদ্ধ রাখছি, শিশুর আনন্দ, সৃজনশীলতা ও মানবিক বিকাশকে উপেক্ষা করছি। শিশুরা যেন কেবল ভালো ছাত্র নয়, ভালো মানুষও হয়Ñ এই লক্ষ্য শিক্ষানীতির মূল হওয়া উচিত। শিক্ষার আনন্দ হারিয়ে গেলে, আমরা শুধুই পরীক্ষা দিতে শেখা মেশিন তৈরির পথে যাই, মানবিকতা, সহমর্মিতা ও নৈতিকতা হারাই। শিশুরা তথ্য জানলেও চিন্তা করতে পারে না, সমস্যা সমাধান করতে পারে না। তারা নম্বর অর্জন করতে পারে, কিন্তু জীবন পরিচালনায় সক্ষম হয় না। শিশুদের সার্বিক বিকাশ না হওয়া মানে জাতির ভবিষ্যৎই ঝুঁকিতে।
সংগীত, নাটক, খেলাধুলা—এ সবই শিশুদের মানবিক ও সৃজনশীল বিকাশের জন্য অপরিহার্য। আমাদের শিক্ষানীতি যদি কেবল বইমুখী ও পরীক্ষাভিত্তিক থাকে, তবে আমরা এক দারুণ বিপদ তৈরি করছি। একটি জাতি যে তার সন্তানদের আনন্দ, সৃজনশীলতা ও শারীরিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত করে, সে জাতি দীর্ঘমেয়াদে কখনো অগ্রগামী হতে পারে না। শিক্ষানীতি বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনো সংস্কার আসে না। নতুন সরকার আসে, পুরোনো নীতি বাতিল করে, নতুন উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বাস্তবে শিশুরা একই একঘেয়ে শিক্ষার যন্ত্রে বন্দি থাকে। শিক্ষকের বদল, পাঠ্যক্রমের পুনর্গঠন, প্রশাসনিক নোটিশÑ এসব শিশুর জীবনে কোনো প্রকৃত পরিবর্তন আনে না। যদি আমরা সত্যিই আধুনিক জাতি গঠন করতে চাই, তবে শিক্ষার ধারণাটিই পাল্টাতে হবে।
শিক্ষা কেবল জ্ঞান দেওয়ার প্রক্রিয়া নয়; এটি মানুষ তৈরি করার প্রক্রিয়া। শিশু যখন গায়, নাটক করে, মাঠে দৌড়ায়- তখন সে কেবল নিজের প্রতিভা নয়, মানবিকতা, সহমর্মিতা, এবং সামাজিক মূল্যবোধও অর্জন করে। শিক্ষার আনন্দ ফিরিয়ে আনতে হবে, খেলাধুলার গুরুত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে। শিশুদের মধ্যে সৃজনশীলতা ও মানবিকতার বীজ বুনতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যদি কেবল পরীক্ষার ফলাফলের জন্য গড়ে ওঠে, তবে আমরা এক মানবিক সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছি। শিশুরা যেন কেবল ভালো ছাত্র নয়, ভালো মানুষও হয়—এই লক্ষ্য নিয়েই নীতি প্রণয়ন করা উচিত। সরকারের উচিত হবে ভুল পরিকল্পনা বাতিল না করে সংশোধন করা। অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ, মনোবিজ্ঞানী, সংস্কৃতিকর্মী ও অভিভাবকের পরামর্শ নিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গঠন করতে হবে। সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা প্রাথমিক স্তরে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এজন্য বাজেট, প্রশিক্ষণ ও পরিকাঠামোর যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে।
শিক্ষা মানে কেবল পেশাগত দক্ষতা অর্জনের মাধ্যম নয়; এটি মানবিকতা, সহমর্মিতা, সৃজনশীলতা এবং আত্মনির্ভরশীলতা শেখানোর মাধ্যম। একটি জাতি যা তার শিশুদের এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, সে জাতি ভবিষ্যতে কেবল জ্ঞানচক্রে আটকে থাকে, মানবিক ও সামাজিক বিকাশ হারায়। শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি কেবল বইমুখী, পরীক্ষা কেন্দ্রিক ও ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল থাকে, তবে শিশুরা বড় হয়ে একঘেয়ে, মানসিকভাবে ক্লান্ত এবং সৃজনশীলতাহীন মানুষ হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে থাকবে প্রতিযোগিতার প্রবণতা, কিন্তু মানবিকতা ও সহমর্মিতা থাকবে কম। শিশুরা তথ্য জানবে, কিন্তু জীবন পরিচালনায় সক্ষম হবে না। শিশুদের শিক্ষার আনন্দ, সৃজনশীলতা এবং শারীরিক বিকাশ ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। সরকার, শিক্ষাবিদ, অভিভাবক ও সমাজের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
শিশুরা যেন সংগীত শেখে, নাটক করে, মাঠে দৌড়ায়—তাদের জীবনে আনন্দই হোক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। যে জাতি তার শিশুদের আনন্দ ও সৃজনশীলতা ফিরিয়ে আনে, সেই জাতিই সত্যিকারের অগ্রগামী জাতি। যদি আমরা আজ পশ্চাৎমুখী চিন্তাধারা পরিত্যাগ করি, তবে বাংলাদেশও একদিন সেই অগ্রগামী জাতির কাতারে দাঁড়াবে। তখন আমরা বলতে পারব, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সত্যিকার অর্থে আলোকিত হয়েছে। শিক্ষা মানে কেবল বই নয়; শিক্ষা মানে জীবন শেখা, মানবিকতা শেখা, মননশীলতা শেখা এবং সৃজনশীলতা বিকাশ করা। সংগীত ও খেলাধুলা হলো সেই শিক্ষার প্রাণ।
শিশুদের হাত থেকে এগুলো কেড়ে নিলে আমরা শুধু তাদের আনন্দ হারাই না, আমরা ভবিষ্যৎ জাতির আশা ও সম্ভাবনাও হারাই। আমরা যদি সত্যিই চাই একটি শক্তিশালী, মানবিক এবং সৃজনশীল জাতি গড়ে তুলতে, তবে শিক্ষানীতি পুনর্বিবেচনা করা বাধ্যতামূলক। সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা প্রাথমিক পর্যায়ে বাধ্যতামূলক করা গেলে, শিশুরা কেবল ভালো ছাত্র নয়, ভালো মানুষও হবে। এই শিক্ষার মাধ্যমেই তারা ভবিষ্যতে দেশের কল্যাণে ব্যবহারযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
শিশুরা কেবল পরীক্ষার নম্বর নয়, তারা হলো জাতির সম্ভাবনা, আনন্দ ও সৃজনশীলতার প্রতীক। তাদের হাসি, গান, খেলা এবং আনন্দ আমাদের জাতীয় সম্পদ। যদি আমরা এই সম্পদকে সংরক্ষণ করতে পারি, তবে দেশ সত্যিকারের অগ্রগতি অর্জন করবে। আমাদের শিক্ষানীতি যদি সঠিক পথে যায়, তবে বাংলাদেশও হতে পারে একটি উদাহরণ, যেখানে শিশুদের সার্বিক বিকাশকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশুরা গড়ে ওঠে সৃজনশীল, মানবিক ও সক্ষম নাগরিক হিসেবে। তারা দেশের জন্য শুধু কর্মক্ষম নয়, মানবিক ও নৈতিকভাবে সম্পূর্ণ নাগরিক হয়।
আজকের শিশুরাই আগামী দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের বিকাশ ও আনন্দকে অগ্রাধিকার না দিলে, আমরা ভবিষ্যতের অন্ধকার রচনা করছি। সরকার ও সমাজের উচিত শিক্ষানীতি পুনর্গঠন করা—যেখানে শিশুদের সৃজনশীলতা, আনন্দ, মানবিকতা এবং শারীরিক সুস্থতা সমানভাবে নিশ্চিত হয়। সংগীত ও খেলাধুলা শিক্ষার অংশ হতে হবে, যাতে শিশুরা কেবল বই নয়, জীবনও শিখতে পারে। আমরা যদি আজ এগুলো নিশ্চিত করি, তবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারব। আর সেই দিনই আমাদের শিক্ষানীতি সত্যিকার অর্থে আলোয় আলোকিত হবে।
শিশুদের শিক্ষা হলো জাতির প্রার্থনা, আশা এবং শক্তি। তাদের জীবনকে সৃজনশীল ও আনন্দময় করার জন্য আজই আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার সুর ফিরিয়ে আনতে হবে, খেলাধুলার আনন্দ ফিরিয়ে আনতে হবে। তখনই আমরা বলতে পারব, আমাদের শিশু শুধু ভালো ছাত্র নয়, ভালো মানুষও হয়ে উঠেছে, এবং সেই শিশুরাই দেশের জন্য কল্যাণকর হয়ে উঠেছে।
লেখক : কলামিস্ট
কেকে/এমএ