রাজশাহীতে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে এইচআইভি ভাইরাসের সংক্রমণ। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে ২৮ জন নারী-পুরুষ এবং একজন হিজড়াসহ মোট ২৯ জন এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন একজন। আক্রান্তদের বেশিরভাগের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে হওয়ায় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সংক্রমণ বৃদ্ধিতে উদ্বেগ বেড়েছে।
বিগত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজশাহীতে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে এবং চলতি বছরে তা মারাত্মক রূপ নিয়েছে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজশাহীতে যৌনকর্মীদের চেয়ে সমকামিতার মাধ্যমে এইচআইভি বেশি ছড়াচ্ছে। গত ছয় বছরে মোট ৯৩ জন এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং এই সময়ে এইডসে মারা গেছেন আটজন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের এইচটিসি (টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সেলিং) সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৭৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে কোনো এইচআইভি পজিটিভ রোগী পাওয়া যায়নি। ২০২০ সালে ৩২১ জনের মধ্যে দুজন, ২০২১ সালে ১,৫২৭ জনের মধ্যে ৮ জন (মৃত ১), ২০২২ সালে ২,০৩১ জনের মধ্যে ৮ জন (মৃত ১), ২০২৩ সালে ২,৩৬০ জনের মধ্যে ২৪ জন (মৃত ৩) এবং ২০২৪ সালে ৩,৫৩২ জনের মধ্যে ২৭ জন (মৃত ৩) পজিটিভ হন।
সর্বশেষ ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২,৩৪৬ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৮ জন পজিটিভ এবং একজনের মৃত্যু হয়েছে।
গত দুই বছরের বিশ্লেষণে দেখা যায়, সমকামিতার মাধ্যমে সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। ২০২৪ সালে ২৭ জন আক্রান্তের মধ্যে ১৬ জন সমকামিতার মাধ্যমে, ১০ জন যৌনকর্মী এবং একজন রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে সংক্রমিত হন। ২০২৫ সালেও ২৮ জন আক্রান্তের মধ্যে ১৭ জন সমকামিতার মাধ্যমে, ১০ জন যৌনকর্মী ও একজন রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন।
রামেক হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারে প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন এইচআইভি পরীক্ষার জন্য আসেন। যাদের ফল পজিটিভ আসে, তাদের কাউন্সেলিং করা হয়। তবে এখানে ওষুধের কোনো ব্যবস্থা নেই। আক্রান্ত রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ পেতে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে যেতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন এইচআইভি পজিটিভ রোগী জানান, রাজশাহীতে ওষুধের ব্যবস্থা না থাকায় তাদের বগুড়ায় যেতে হয়। রাজশাহী হাসপাতালে এই ওষুধ পাওয়া গেলে রোগীদের জন্য অনেক উপকার হতো।
রামেক হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারের কাউন্সেলর রেজাউল করিম বলেন, আক্রান্তরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়। নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তাদের সুস্থ থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়।
এইচটিসি সেন্টারের ফোকাল পার্সন ডা. ইবরাহীম মো. শরফ বলেন, এইচআইভি সংক্রমণের প্রধান কারণ হলো যৌনমিলন। এছাড়া, আক্রান্ত মা থেকে শিশুর দেহেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। তিনি প্রতিরোধের উপায় হিসেবে প্রতিবার যৌনমিলনের সময় কনডম ব্যবহার, একাধিক যৌনসঙ্গী পরিহার এবং রক্ত পরীক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
রাজশাহীতে এইচআইভি চিকিৎসার জন্য একটি এআরটি (অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি) সেন্টার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। এটি চালু হলে রোগীদের আর বগুড়ায় যেতে হবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক লজ্জা ও অসচেতনতার কারণে অনেকেই এই রোগ সম্পর্কে জানতে পারছেন না বা জানলেও গোপন রাখছেন। তারা বলেন, “এই ভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্কুল পর্যায়ে যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা জরুরি।”
কেকে/ আরআই