নির্বাচিত সরকার ছাড়া ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি হবে না, অর্থনীতিতেও গতি ফিরবে না- এমন মত প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা। তাদের মতে, বাংলাদেশে ব্যবসায়িক সংস্কারের বিষয়ে অর্থবহ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে না যতক্ষণ দেশে স্থিতিশীল ও নির্বাচিত সরকার না আসবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশে বিনিয়োগের আগে স্থানীয় বেসরকারি খাতের কাছে বাস্তব পরিস্থিতি জানতে চান। তাই কাগুজে প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাস দিয়ে দীর্ঘদিন তাদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়।গতকাল সোমবার গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত অর্থনৈতিক সংস্কারবিষয়ক এক সেমিনারে এসব কথা বলেন ব্যবসায়ীরা। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ পলিসি এক্সচেঞ্জ-এর অর্থনীতিবিদ হাসনাত আলম।
অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা শ্রম আইন এবং শ্রমিক সংগঠন গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ইস্যুর ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি আগামী নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সুপারিশ করেন। আর জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ পিছিয়ে দিতে জাতিসংঘে আবেদনের জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
মূল প্রবন্ধে হাসনাত আলম বলেন, আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনাম ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে তিনি নিয়ন্ত্রক সংস্থার দক্ষতা বাড়ানো, বাণিজ্য প্রক্রিয়া আধুনিকায়ন এবং উৎপাদনশীলতা-নির্ভর বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
উপস্থাপনায় তিনি দেখান, বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বিশ্ব গড়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম এবং প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে। তিনি বিনিয়োগ পরিবেশে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেন কাঠামোগত সমস্যাগুলো- যেমন বিনিয়োগ উন্মুক্ততার ঘাটতি, অদক্ষ লজিস্টিক ব্যবস্থা, দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি এবং জটিল কর কাঠামো।
হাসনাত আলম সতর্ক করে বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে সুশাসন, শুল্কনীতি সংস্কার এবং জমির সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণে লক্ষ্যভিত্তিক সংস্কার না আনলে বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান অস্থির বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।’
প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন টেকসই করতে হলে সংস্কার শুরু করতে হবে মূল নকশাগত স্তর থেকে। তিনি বলেন, প্রশাসনিক কাঠামোর মৌলিক ত্রুটি দূর না হলে সাম্প্রতিক কিছু সাফল্য সত্ত্বেও দেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হতে থাকবে।
তিনি ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দেন, আগামী নির্বাচিত সরকারের আমলে সংস্কারের যে সুযোগ আসবে, তা যেন হাতছাড়া না হয়, যেমনটি হয়েছিল ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনের পর। তিনি বলেন, ‘আমরা সংস্কারের জন্য একটি ঐকমত্য কমিশন গঠনের কাজ করেছিলাম, কিন্তু অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন হয়নি।’
লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, অটোমেশন বা ডিজিটাল রূপান্তরের প্রধান বাধা প্রযুক্তি নয়- মানসিকতা। ‘জনগণ ও সরকারি কর্মকর্তাদের মানসিক পরিবর্তনই সবচেয়ে জরুরি।’
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংস্কার ত্বরান্বিত করতে বেসরকারি খাতকেই চাপ সৃষ্টি করতে হবে। ‘এসএমই খাতে এখনো শক্তিশালী কণ্ঠ নেই, তবে আমরা কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছি- যেমন- এসএমই কার্ড চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে উদ্যোক্তারা ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে ৩ হাজার ডলার পর্যন্ত ডিজিটাল লেনদেন করতে পারবেন।’
সেমিনারে বাংলাদেশ থাই চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ‘শ্রম আইন এবং শ্রমিক সংগঠন গঠনের বিষয়ে এখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে কেন? তিন মাস পরই নির্বাচিত সরকার আসবে, এ বিষয়ে নির্বাচিত সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে দেন। এখন আমরা অর্থনৈতিক অনেক সংস্কারের কথা বলছি। কিন্তু কিছু হচ্ছে না। কোনো মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) অথবা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) হচ্ছে না।’
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের যে অবস্থা, তাতে এখনই এলডিসি উত্তরণের পরিস্থিতি নেই। এরই মধ্যে আমরা ১৬টি ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছি। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, প্রয়োজনে জাতিসংঘ এসে আমাদের পরিস্থিতি তদন্ত করে দেখুক। এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে এলডিসি থেকে উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন করা হোক।’
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘এখন আমাদের নির্বাচিত সরকার দরকার। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছর মানুষ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার না পেলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে না।’
সিরামিকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি মইনুল ইসলাম বলেন, সুশাসন ছাড়া কোনো দেশের ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। ক্রেতারা এখন আতঙ্কিত, তারা পণ্য কিনতে চায় না। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র সমাধান নির্বাচন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আপনারা বেপরোয়া হচ্ছেন। কিন্তু যে দেশের বিমানবন্দর আগুনে পোড়ে, সেখানে কে বিনিয়োগ করবে? দেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ নেই।’
ইউসিবির চেয়ারম্যান শরীফ জহীর বলেন, ব্যাংক খাতে বিগত সরকারের সময়ের মতো অবস্থা চলতে থাকলে খাতটিকে দুই বছরের বেশি টিকে থাকতে পারত না। বিশেষ উদ্যোগের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তির সময় কমিয়ে আনতে হবে। তা না হলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বাংলাদেশ সিরামিক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সংস্থা (বিসিএমইএ)-এর সভাপতি ময়নুল ইসলাম দেশের সিরামিক শিল্পের টেকসই বৃদ্ধির জন্য সুশাসনের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘শাসন ব্যবস্থা উন্নত না হলে কিছুই উন্নতি হবে না। যখন আমি সংস্কারের সুযোগ ও সামনে আসা চ্যালেঞ্জগুলো দেখি, তখন গভর্ন্যান্স বা শাসন ব্যবস্থার সংস্কারই প্রথম হতে হবে।’
কেকে/এআর