সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫,
২৮ আশ্বিন ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
শিরোনাম: ১১ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় এক বিলিয়ন ডলার      জিয়া পরিবার জনগণের পরিবার : আমান উল্লাহ      রোমে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা      ২০০ তালেবান সৈন্যকে হত্যার দাবি পাকিস্তানের      বাতিল হওয়ার শঙ্কায় বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনার ভারত সফর      বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে দেশে স্বৈরশাসন পাকাপোক্ত হয়েছিল      প্রেসক্লাবে শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গে সাউন্ড গ্রেনেড-লাঠিচার্জ      
খোলাকাগজ স্পেশাল
রাজনৈতিক বন্দোবস্তে পুঁজিবাজারে লুট
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশ: রোববার, ৫ অক্টোবর, ২০২৫, ৮:৫৩ এএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

বছরের পর বছর ধরে পুঁজিবাজারে যা ঘটছে, তা কোনো দুর্ঘটনা নয়; এটি নৈতিক অবক্ষয়, রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে সংঘটিত একটি পরিকল্পিত লুটপাট। সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও নৈতিকতা ছাড়া কোনো সংস্কারই টেকসই হতে পারে না। আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে রেগুলেটরি সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা বাড়াতে হবে, মানসম্মত অডিট রিপোর্ট ও তথ্যপ্রবাহে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে এবং বাজারের সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

শনিবার জাগোনিউজ২৪.কম আয়োজিত ‘পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ : সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাগোনিউজ২৪.কম এর সম্পাদক কে. এম. জিয়াউল হক এবং সঞ্চালনা করেন ডেপুটি চিফ রিপোর্টার সাঈদ শিপন।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরিয়ে আনতে বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা, মানসম্মত অডিট রিপোর্ট ও তথ্যপ্রবাহে স্বচ্ছতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

তথ্যপ্রবাহে স্বচ্ছতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে শাকিল রিজভী জানান, অনেক কোম্পানির ওয়েবসাইটই ঠিকমতো আপডেট করা হয় না। বিনিয়োগকারীরা সঠিক তথ্য পান না। অথচ স্টক এক্সচেঞ্জ শুধু কোম্পানির সরবরাহ করা তথ্যই প্রকাশ করে। তাই কোম্পানিগুলোকেই আরো দায়িত্বশীল হতে হবে।

মানসম্মত অডিট রিপোর্টের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, যদি অডিট রিপোর্টে বিনিয়োগকারীর বিশ্বাস না থাকে, তাহলে বাজারে আস্থাও ফিরবে না। আমরা শুধু কাগজে-কলমে শেয়ারদর বাড়াতে চাই না, বরং কোম্পানির বিক্রি, উৎপাদন ও মুনাফা বাড়াতে হবে।

বাজার ঠিক করতে একাধিক পক্ষের সমন্বিত সংস্কার চাই, শুধু কমিশন বা একক প্রতিষ্ঠান দিয়ে সংস্কার সম্ভব নয় উল্লেখ করে শাকিল রিজভী বলেন, ডিএসই, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সাংবাদিক, আইনজীবী, অর্থনীতিবিদ ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরো বলেন, কোনো প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে তার যৌক্তিকতা দিতে হবে। পারস্পরিক আন্ডারমাইন না করে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।

শাকিল রিজভী জানান, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনো জিডিপির ৬০ শতাংশ ছুঁতে পারেনি, অথচ উন্নত বাজারে এ হার ৭০-৮০ শতাংশ। তবে গত এক বছরে দুর্বল কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তি না হওয়া ইতিবাচক দিক। তিনি বলেন, নতুন কোম্পানি তখনই বাজারে আসবে, যখন লেনদেন বাড়বে। আইপিও না থাকলে বিও অ্যাকাউন্ট কমে যাওয়া স্বাভাবিক।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজার আগামী ১০ বছরে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে রূপ নিতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন। তবে তার মতে, এ সম্ভাবনা বাস্তবায়নের মূল চাবিকাঠি হলো সঠিক নেতৃত্ব, আর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রাজনীতি।

ইমন বলেন, ‘আমাদের দেশে শত শত কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসার যোগ্য, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, হয়রানি আর অব্যবস্থার কারণে তারা আসতে চায় না। কমিশনে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব না থাকলে বাজার এগোবে না।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘বছরের পর বছর ধরে নৈতিক অবক্ষয়, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব পুঁজিবাজারের ইকোসিস্টেম ধ্বংস করেছে। নেতৃত্বে ভুল লোক বসানোর কারণেই বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারিয়ে গেছে।’

ডিএসই পরিচালক আরো বলেন, ‘সংবিধানে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। অর্থনীতির মূলধারার সঙ্গে শেয়ারবাজার এখনো সম্পৃক্ত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে আমাদের বাজারের আকার জিডিপির তুলনায় খুবই ছোট এখনো এটি কোনো পরিপূর্ণ পুঁজিবাজার নয়।’

ফেলো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (এফসিএ) মাহমুদ হোসেন বলেন, আমাদের দেশে বিনিয়োগকারীরা শুধু মুনাফা থেকেই বঞ্চিত হন না, বরং নিজেদের পুঁজিরও নিরাপত্তা পান না। যেখানে আইনের শাসন নেই, সেখানে বিনিয়োগ নিরাপদ থাকা অসম্ভব। 

পুঁজিবাজারে রাজনৈতিক বন্দোবস্তে পুঁজি লুট হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে বছরের পর বছর যা ঘটেছে, তা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে সংঘটিত পুঁজি লুট।

মূলধন সংগ্রহ এখনো কঠিন জানিয়ে তিনি বলেন, পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ এখনো একটি দীর্ঘসূত্র ও জটিল প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া অনেক সহজ। তাই নতুন কোম্পানিগুলো বাজারে আসতেই চায় না।

আস্থাহীনতার গভীর সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কথা ও কাজে অমিল থাকলে আস্থা ফিরবে না। ক্রেতা, বিক্রেতা ও রেগুলেটর-তিন পক্ষের মধ্যে যখন বিশ্বাসের অভাব থাকে, তখন বাজার কখনোই স্থিতিশীল হতে পারে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকসহ প্রায় সব রেগুলেটরি সংস্থার কার্যকারিতা ভেঙে পড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যেখানে গভর্নর নিজেই কোনো স্কিমে বিনিয়োগ না করতে সিইওকে ধমক দেন সেখানে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। পুঁজিবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। কিন্তু কয়টি মামলা হয়েছে? কয়টি তদন্ত হয়েছে? এ লুটপাট ছিল পরিকল্পিত। কিন্তু রাজনৈতিক আপসে দুর্নীতিবাজরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তিনি আরো বলেন, তবে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতা ছাড়া কোনো সংস্কারই টেকসই হতে পারে না। আমাদের চরিত্র বদলাতে হবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে হবে এবং যারা লুটপাটে অংশ নিয়েছে তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই ফিরবে আস্থা, আর পুঁজিবাজার চলবে টেকসই পথে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিএসইসি কর্তৃক গঠিত পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য মো. আল-আমিন বলেন, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সাধারণ বিনিয়োগকারীর মতোই ব্যবহার করা হয়। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে পুঁজিবাজারকে নেগলেক্ট (অবহেলা) করে রাখা হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয়ভাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলেও বাংলাদেশে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা (আমলা) নিজেদের অবস্থান ছাড়তে চান না। ফলে পুঁজিবাজারে নেগলেকশন চলছে এবং তারা এখান থেকে ব্যক্তিগত সুবিধা নিচ্ছেন।

মো. আল-আমিন বলেন, ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে টেকসই ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতার মূল কারণ গভর্নেন্স ব্যর্থতা। এজন্য অডিটর, ভ্যালুয়েশন ফার্ম ও স্বাধীন পরিচালকদের জবাবদিহি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ‘ফিট অ্যান্ড প্রপার’ তালিকা প্রণয়ন করে যোগ্য ও অভিজ্ঞ পরিচালকদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এসব পদক্ষেপ ছাড়া বিনিয়োগকারীর আস্থা ও বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেক সংস্কার কমিশন হয়েছে, কিন্তু সবগুলো ফলপ্রসূ হয়নি। আমরা সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করেছি প্রতিটি মিটিং, আলোচনা ও সুপারিশ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বাজারকে একটি টেকসই ও সুশাসিত কাঠামো উপহার দেওয়া।’

ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল অ্যানালিস্ট মো. মামুনুর রশীদ বলেন, গত ১৪ মাসে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন কমিশন ও নতুন নেতৃত্ব এলেও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরেনি। যারা ১৪ মাস আগে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, আজ তারা নিজেদের অর্থ মাত্র ৫০ টাকায় দেখতে পাচ্ছেন। এ যেন এমন সময়, যখন দেশ হাসে, বিনিয়োগকারী কাঁদে।

ইউনাইটেড এয়ারের শেয়ার দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় বিনিয়োগকারীরা তাদের অর্থ পাচ্ছেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজরা পালিয়ে গেলেও তাদের সম্পদ উদ্ধার ও বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ এখনো নিশ্চিত হয়নি।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতাও তিনি প্রকাশ্যে তুলে ধরেন। জানান, জিকিউ বলপেনের শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিকভাবে ৫৯১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার পরও কমিশনের নিস্তব্ধতা বিনিয়োগকারীদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল অ্যানালিস্ট শেষে বলেন, পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে স্বচ্ছতা, সময়মতো তথ্য প্রকাশ, জবাবদিহিতা ও শক্তিশালী নজরদারি প্রয়োজন। বিএসইসি, ডিএসই এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।

কেকে/ এমএস
আরও সংবাদ   বিষয়:  রাজনৈতিক বন্দোবস্ত   পুঁজিবাজার   লুট  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

ট্রাক ভাড়া করে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করত তারা
শিশু বলাৎকার ও হত্যার অভিযোগে কিশোর গ্রেফতার
১১ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় এক বিলিয়ন ডলার
মুরাদনগরের ওসি জাহিদুরের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বসহ নানা অভিযোগ, অপসারণ দাবি
জিয়া পরিবার জনগণের পরিবার : আমান উল্লাহ

সর্বাধিক পঠিত

আসছে নাটক ‘অপ্রকাশিত ভালোবাসা’
চিকিৎসক ও জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা
রাজশাহীতে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস পালিত
নির্বাচন নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে : তানভীর হুদা
মৌলভীবাজারে জামায়াত ও খেলাফত মজলিসের স্মারকলিপি
সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close