সরকারপ্রধানের ঘোষণা অনুযায়ী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র চার মাস। এ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির ময়দানে চলছে নানা রকম খেলা। রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কৌশল নিচ্ছে নিজেদের ভোট বাড়ানোর জন্য। সভা-সমাবেশ ও শোডাউনে নিজ নিজ শক্তি-সামর্থ্যরে জানান দিচ্ছে কেউ কেউ। সেই দৌড়ে অন্য দলগুলোর চেয়ে এক পা এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আর অভিনব কৌশলে অন্যদের প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাচ্ছে দলটি।
বিগত সরকারের আমলে জামায়াতের শীর্ষ একাধিক নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন আরো দুই নেতা। এরপর দলটির নিবন্ধন বাতিল ও রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তখন গুপ্ত রাজনীতির পথে যায় জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির।
২৪-এর ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে আবারো প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফেরে দলটি। এরপর থেকেই নিচ্ছে একের পর এক পরিকল্পনা। বিশেষ করে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার মাস্টার প্ল্যানে এগোচ্ছে দলটি। যার অংশ হিসেবে মাঠ প্রসাশন থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রশাসনিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বেড়েছে বিদেশি সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ। কূটনৈতিকপাড়ায়ও ব্যাপক আনাগোনা দেখা যাচ্ছে দলটির নেতাদের।
ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এগুলো সবই আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটির বিশেষ পরিকল্পনার অংশ। তারা (জামায়াত) আগামী নির্বাচনে নিজেদের প্রধান বিরোধী দলে দেখেতে চায়। ফলে তাদের টার্গেট হচ্ছে, এবার প্রধান বিরোধী দল হওয়া এবং পরের নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই।
এ ছাড়া নতুন প্রজন্মের একটি অংশের মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি ঝোঁক রয়েছে। আর তাদের বড় একটি অংশ জামায়াত মতাদর্শের। সম্প্রতি ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিপুল সাফল্য জামায়াতকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। দলটি মনে করছে, এ দুই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে। যার সুফল ঘরে তুলতে পারবে তারা।
জামায়াতের এ আত্মবিশ্বাসের ইঙ্গিত মেলে দলটির নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে। গত শুক্রবার খুলনায় এক সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার দাবি করেন, জামায়াতের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দলটি এখন ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। একইসঙ্গে বিএনপিকেও আক্রমণ করেন তিনি। গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘একটি শক্তি মৌলিক সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করছে, চাঁদাবাজি করছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘জামায়াত ক্ষমতায় গেলে কোনো এমপি বা মন্ত্রী সরকারি গাড়ি, বাড়ি কিংবা বিশেষ সুবিধা নেবে না।’ তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল জানান, ক্ষমতায় গেলে সব তরুণকে কর্মসংস্থানের আওতায় আনা হবে। চাকরি দিতে না পারলে বেকার ভাতা দেওয়া হবে।’
এ আলোচনার মধ্যেই গতকাল রোববার জামায়াতে ইসলামী দলীয় প্রতীকে কিছু পরিবর্তন দেখা গেছে। যা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হতে পারে। দলটির প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ঠিক রেখে কিছুটা জাতীয় পতাকার আদলে তৈরি করা হয়েছে এ লোগো।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, আমাদের লোগো পরিবর্তন করা হচ্ছে। আমিরের নির্দেশনায় বেশ কয়েকটি লোগো ডিজাইন করা হয়েছে। তবে কোন লোগোটি ব্যবহার করা হবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আজকের এ লোগো ভুলবশত ছবিতে চলে আসছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে লোগো চূড়ান্ত করা হবে। তিনি আরো বলেন, লোগো নিয়ে আমাদের নির্বাহী পরিষদে আলোচনা হয়েছে। চূড়ান্ত হলে সেটি আমাদের অফিসিয়াল লোগো হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কেন লোগো পরিবর্তন করা হচ্ছে- জানতে চাইলে মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, আমাদের আগের লোগো আমরা কখনো অফিসিয়ালি ব্যবহার করিনি। বিভিন্ন গণমাধ্যম ব্যবহার করা হতো।
এই লোগে পরিবর্তন নিয়েও নতুন করে তৈরি হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেকের মতে, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতি করতেই মূলত দলটি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের রাজনীতিতে তারা নিজেদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে উপস্থাপন করলেও আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের এ পরিচয়ে বাইরে প্রমাণ করতে চাচ্ছেন। যা বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সখ্য এবং কূটনৈতিক সম্পর্কে ভূমিকা রাখবে।
তবে এ নিয়ে কঠোর মন্তব্য করছে সমালোচকরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন লিখেছেন- ‘জামায়াতে ইসলামী তাদের লোগো পাল্টে ফেলেছে। আগের লোগোতে থাকা ‘আল্লাহ’ আর ‘আকিমুদ দ্বীন’ শব্দ মুছে দিয়ে নতুন দলীয় প্রতীক বানিয়েছে। ক্ষমতার জন্য তারা আল্লাহ ও আকিমুদ দ্বীনকেও বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেনি! এই হলো সেই জামায়াত। ধর্মকে ব্যবসার পণ্য বানানো এক রাজনৈতিক প্রতারক দল। যারা এখনো জামায়াতকে ইসলামি দল ভেবে বোকার স্বর্গে বাস করছেন, তারা চোখ খুলে দেখুন- জামায়াতের কাছে ইসলাম নয়, রাজনীতি আর ক্ষমতাই একমাত্র সত্য।’
কেকে/এআর