দেশের অন্যতম চা শিল্পাঞ্চল ও পর্যটন নগরী মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে রয়েছে অসংখ্য পর্যটনস্পট ও নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার আয়তনের এ অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত সবুজ চা বাগান যেন পাহাড়ের ঢালে এক অবারিত সবুজ গালিচা। যেদিকে দুচোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। সুনীল আকাশ, সাজানো সবুজ চা বাগান আর সুউচ্চ সবুজ পাহাড়ি টিলায় ঘেরা শ্রীমঙ্গল যেন সৌন্দর্যের লীলাভূমি।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি শ্রীমঙ্গলে বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোর সঙ্গে চা বাগানের ভেতরে অবস্থিত নয়নাভিরাম লেকগুলো পর্যটকদের মাঝে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম ভুরভুিরয়া লেক। উপজেলার ভুরভুরিয়া চা বাগানে অবস্থিত নয়নাভিরাম ভুরভুরিয়া লেক এখন পর্যটকদের হাতছানি দিচ্ছে। এই লেকটি চম্পা লেক নামেও পরিচিত।
জানা যায়, নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা এ লেকটি শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। লেকের দক্ষিণ-পূর্বে পাঁচ তারকা মানের হোটেল গ্র্যান্ড সুলতানের সীমানা, পশ্চিমে মূল ভাড়াউড়া চা-বাগান, উত্তরে রেললাইন ও পূর্বে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। আবার শ্রীমঙ্গল শহরের চৌমুহনা থেকে পাকা সড়কে কলেজ সড়ক হয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পেরুলেই ভাড়াউড়া চা-বাগান। এই চা-বাগানের ভেতর দিয়ে কাঁচা রাস্তায় আরও প্রায় দেড় কিলোমিটার পাহাড়ের গা বেয়ে একটু হেঁটে যেতে হবে। হেঁটে চলার পথটি এতোই সুন্দর যে, হাঁটার ক্লান্তি আপনিই ভুলে যাবেন। আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিলেই দেখা মিলবে ভুরভুরিয়া লেকের।
এছাড়া শহর থেকে ভানুগাছ সড়ক ধরে কিছুদূর এগুলেই ফিনলে চা কোম্পানীর ভুরভুরিয়া চা-বাগানের প্রবেশ পথ। আবার ডলুছড়া এলাকায় (সাদ্দামের চায়ের দোকান) এর পাশ দিয়েও বাগানের লেকে প্রবেশ করা যায়। শহর থেকে মোটরসাইকেল, সিএনজি, অটোরিক্সা, জীপ বা যেকোনো গাড়ি রিজার্ভ নিয়ে সরাসরি লেকে যাওয়া যাবে। লেকে পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ১৫ থেকে ২০মিনিট।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ভুরভুরিয়া চা বাগানের ১৮নং সেকশনে অবস্থিত ভুরভুরিয়া লেকের চারদিকে উচুঁ-নিচু টিলা আর সবুজে ঘেরা চারপাশে চা বাগান, এরই মাঝখানে মনোমুগ্ধকর বিশাল লেক। প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে এ লেকটি উঁচু টিলার ওপর থেকে দেখতে বেশ অপূর্ব লাগে। পর্যটকরা এ লেকে আসলে উঁচু পাহাড়, সবুজ টিলা, চা-বাগানের আঁকাবাঁকা পথ, লাল মাটির রাস্তা, শাপলাসহ নানা জাতের জলজ উদ্ভিদ দেখতে পাবেন। লেকের স্বচ্চ পানি, সুনীল আকাশ আর ছবির মতো চা বাগানের এই মনোরম দৃশ্য পর্যটককে মোহিত করবে।
এদিকে টিলা ও সবুজের সমারোহে ঘেরা ভুরভুরিয়া লেকটি যেকোনো পর্যটককের হৃদয় মনে দোলা দেবে নিঃসন্দেহে। কাঁচা চা পাতার আকুল করা গন্ধ নিয়ে লেকের পাড়ে টিলার ওপর দাঁড়ালে বা লেকের স্বচ্ছ পানিতে নামলে যে কারো মনকে করবে মোহাবিষ্ট। লেকের স্বচ্ছ পানিতে টিলার ওপর অবস্থিত চা বাগানের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে। নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাণবন্ত সময় কাটানোর অসাধারণ একটি স্থান। উঁচু-নীচু টিলায় ঘেরা এ লেকটির দুর্বার আকর্ষণে অনেকেই ছুটে আসেন একটু প্রশান্তির ছোঁয়া পেতে।
টিলায় টিলায় সবুজ-শ্যামল ঢেউ খেলানো চা-বাগান, সহজেই মনকে করে পুলকিত। এখানে আরও বাড়তি আনন্দ যোগায় বন্যপ্রাণীকূল। পড়ন্ত বিকেলে লেকের পাশে সবুজ চা বাগানের ছায়াবৃক্ষে দেখা যায় অসংখ্য বানর। বানরে লাফালাফি আর লেক এলাকায় পাখিদের উড়াউড়ি এবং কিচিরমিচি শব্দে মন চাঞ্চল্যকর হয়ে উঠে।
চা বাগানের বাসিন্দা সুমন হাজরা বলেন, এ লেকটি দেখার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন আসেন। টিলার ওপর থেকে এ লেকের ছবি তোলেন। অনেক সময় গেট বন্ধ থাকে, তখন বাগানের ম্যানেজার সাহেবের অনুমতি নিয়ে এখানে আসতে হয়।
প্রকৃতিপ্রেমী মো. সোলেমান পাটোয়ারী বলেন, ভুরভুরিয়া লেকটি দেখতে বেশ মনোরম। নয়নাভিরাম সৌন্দর্য যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে পর্যটকসহ প্রকৃতিপ্রেমীদের। এই লেকটিকে কেউ কেউ ভাড়াউড়া ও চম্পা লেক নামেও চিনেন। এখানে সময় কাটাতে খুবই ভালো লাগে। অনেক পর্যটক চা বাগানের এই লেক দেখার জন্য আসেন।
বাংলাদেশীয় চা সংসদের সিলেট ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান ও ভাড়াউড়া টি ডিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার গোলাম মোহাম্মদ শিবলী জানান, ২০২১ সালে টি প্লান্টেশনের জন্য ভুরভুরিয়া চা বাগানে এই লেকটি তৈরি করা হয়েছে। মূলত চা-বাগানে সেচের জন্য তৈরি করা হয়েছে এই লেক। এই লেকের চারপাশে ১০০ হেক্টর টিলা ও সমতলে চা বাগান করা হয়েছে। সেচ কার্য ছাড়াও লেকে করা হয়েছে মৎস চাষও।
চা বাগান ও লেকে আসা পর্যটকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, চা বাগান যেহেতু একটি ইন্ডাস্ট্রি। তাই এখানে প্রবেশ করে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয় এমন কাজ করা যাবে না। চা গাছের ডাল বা পাতা ছিঁড়লে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
কেকে/ আরআই