রাজধানীর মোহাম্মদপুর সংলগ্ন আদাবরের ১০ নম্বর বালুর মাঠের বস্তিতে চা দোকানি রিপনকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দেয় এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী ‘বেলচা মনির’। বর্তমানে পুরো বালুর মাঠের বস্তিতে ‘বেলচা মনির’ ও তার বাহিনীর তাণ্ডবে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
বস্তিটি পরিচিত ‘হাক্কার পাড়’ নামেও। প্রায় ৫০০ ঘরের এই বস্তিতে প্রতিদিনই চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও মাদক বেচাকেনা চলছে মনির বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। নারী গার্মেন্টস কর্মী থেকে শুরু করে রিকশাচালক—কেউই রেহাই পাচ্ছেন না তাদের হাতে। অভিযোগ রয়েছে, গার্মেন্টসের বেতন পেলেও সেটি লুটে নেয় মনিরের দল।
চা দোকানি রিপনকে হত্যা
গত ১৬ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে নিজ ঘরে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় চা দোকানি রিপন মিয়াকে। তিনি ছিলেন স্থানীয় আব্দুল আলীর বাড়ির দীর্ঘদিনের (প্রায় ১৭ বছর) ম্যানেজার এবং প্রায় ২০ বছর ধরে পরিবার নিয়ে বাস করতেন ওই বস্তিতে।
রিপনের ছেলে জানান, “ভোরে ঘুম ভাঙতেই দেখি দরজার বাইরে হট্টগোল, কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘরে ঢুকে পড়ে ৮-৯ জন। আমার বাবাকে ঘুম থেকে তুলে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। আমি চিৎকার করলে আশেপাশের কয়েকজন এগিয়ে এলেও মনিরকে দেখে সবাই পালিয়ে যায়।”
নিহতের স্বজনদের দাবি, শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি দুর্বৃত্তরা। মরদেহের ওপরও এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেয় তারা।
‘বেলচা মনির’—আতঙ্কের নতুন নাম
স্থানীয়রা জানান, এই বাহিনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে চলতি বছরের ৫ আগস্টের পরপরই। মূলত ‘কব্জিকাটা আনোয়ার’-এর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত হলেও এখন নিজেই একটি বাহিনী গড়ে তোলে মনির। তার দলে রয়েছে ২০-৩০ জন দুর্বৃত্ত, যাদের অধিকাংশই জড়িত মাদক ব্যবসা, ছিনতাই ও গ্যাং কালচারে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই বাহিনীর পেছনে রয়েছেন বিএনপির এক প্রভাবশালী স্থানীয় নেতা। ফলে প্রশাসনের তেমন কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। এমনকি, পুলিশও অনেক সময় ঢুকতে ভয় পায় হাক্কার পাড় বস্তিতে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রিপন হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়—মনির, জীবন ওরফে বাবু, রাকিব, আকাশ ওরফে রাকিব, জাহিদ, ফর্মা জামাল, মনিরের বড় ভাই বাবু রবিউল এবং কুমির রুবেল।
পুলিশকে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে হামলা
এর আগে, বেলচা মনিরের বাহিনী পুলিশের ওপর মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে হামলা চালায়। পুলিশের একাধিক সদস্যকে কুপিয়ে জখমও করা হয় ওই ঘটনায়। এরপর থেকেই এলাকায় একপ্রকার অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে এই গ্যাং।
অস্ত্র ও মাদকের আখড়া
স্থানীয়রা জানান, রহমান মিয়ার বাড়ি এখন বেলচা মনির বাহিনীর অস্ত্রাগার। সেখানে সারারাত অবস্থান করে দলটি। সরেজমিনে গেলে হাতুড়িসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র দেখা যায়। ওই বাড়ির একাধিক ভাড়াটিয়া ভয়ে বাসা ছেড়ে চলে গেছেন বলেও জানান স্থানীয়রা।
সেনাবাহিনীর অভিযান, পুলিশের মামলার অগ্রগতি
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার পর এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম জাকারিয়া বলেন, “নিহত রিপনের স্ত্রী একটি মামলা করেছেন। আমরা আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চালাচ্ছি।”
জিম্মি বস্তিবাসী, চায় স্থায়ী সমাধান
বস্তির অনেক বাসিন্দা জানিয়েছেন, এখন তারা রাতে ঘুমাতে পারেন না। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো, গার্মেন্টস কর্মীদের কাজে যাওয়া—সবকিছুই এখন অনিশ্চিত। কেউ মুখ খুলতে চায় না, সবাই ভয়ে।
একজন বৃদ্ধ রিকশাচালক বলেন, “মনির আর তার বাহিনী যা খুশি তা-ই করে। আমরা শুধু তাকিয়ে দেখি, কিছু বলার সাহস নাই।”
কেকে/ আরআই