আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে আনুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর)সহ কয়েকটি দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ দাবি আদায়ে রাজধানী ঢাকা থেকে বিভাগীয় শহর এবং জেলা উপজেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতারা। এসব সমাবেশে দলটির শীর্ষ নেতাদের অনেকটা লাগামহীন বক্তব্য দিতে দেখা যাচ্ছে। যা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জন্ম দিচ্ছে বিতর্ক, জনমনে সৃষ্টি করছে বিভ্রান্তি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাকসু) নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের বিজয়ের পর জামায়াতের রাজনৈতিক মুভমেন্টে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। এতে তাদের বক্তব্যে এক ধরনের দম্ভ স্পষ্ট হচ্ছে।
শুক্রবার বিকালে চট্টগ্রাম নগরে আয়োজিত এক সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন দলটির চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুহাম্মাদ শাহজাহান। এ সময় তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর থেকে তরুণ ছাত্রসমাজ বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের যুগ থেকে গণতন্ত্রের যুগে পদার্পণ করেছে। এ ধারাবাহিকতায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী সরকার গঠনের মতো আসনে বিজয়ী হবে। ফলে জামায়াতে ইসলামী সরকারি দল হবে। বিএনপিকে বিরোধী দলে যেতে হবে।’
এদিকে জামায়াতের এ নেতার বক্তব্য নিয়েও নতুন করে তৈরি হয়েছে সমালোচনা। ‘জামায়াতে ইসলামী সরকারি দল হবে। বিএনপিকে বিরোধী দলে যেতে হবে।’ এ বক্তব্য প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, সরকারি দল জামায়াত নাকি বিএনপি হবে; বিষয়টি এভাবে বলা উচিত হয়নি। কারণ, এটা আগামী নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে জনগণ ঠিক করবে। ফলে রাজনৈতিক নেতাদের এমন মন্তব্য অতি-দাম্ভিকতার প্রকাশ।
নগর জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মুহাম্মদ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে ইঙ্গিত করে রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর তিনটি দল দেশে শাসন করেছে। একটি ফ্যাসিবাদী দল। আরেক দল অতিরিক্ত দালালি করার কারণে নিজেরাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরেকটি দল বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করেছে। ৫ আগস্টের পর থেকে চাঁদাবাজি, বালু খাওয়া-পাথর খাওয়া শেষ করেছে; এবার বাংলাদেশের মানচিত্র খাওয়ার ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত হয়েছে।’
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর প্রধান উপদেষ্টার ডাকে আমরা সাড়া দিয়ে এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছি।
সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পরও আবারো কেন আন্দোলনের নামতে হচ্ছে। কারণ সরকার চাপের মুখে মাথা নত করেছে। তাই সরকারকে সোজা করার জন্য দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাজপথে আন্দোলনে নেমেছি।’
শুক্রবার বিকালে রংপুর নগরীর টাউন হল চত্বরে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলপূর্ব আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে গোলাম পরওয়ার এ কথা বলেন।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, যারা কোটি কোটি টাকা দিয়ে মনোনয়ন বাণিজ্য করতে পারবে না তারাই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় না। যারা কর্তৃত্ববাদী সরকার চালাতে চায় তারাই পিআর পদ্ধতি চায় না। এ পিআর নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থা পিআর নিয়ে সার্ভে করেছে। ৭০ শতাংশ মানুষ পিআর এর পক্ষে আছে। শুধু তাই নয় ঐক্যবদ্ধ কমিশনে যে ৩১টি দল রয়েছে, তার মধ্যে ২৫টি দলই পিআর পদ্ধতি চায়। অথচ বিএনপির কিছু নেতা বলছে পিআর বাংলাদেশের মানুষ বোঝে না। তারা পিআরের সঙ্গে ইভিএমের তুলনা করছে। ইভিএম আর পিআর এক নয়। তাই দেশের মানুষকে আর হাইকোর্ট দেখাবেন না। অনেক নেতা বলছেন পিআর খায় না মাথা দেয়। কী আজব ব্যাপার! পলিটিক্যালি কেউ এমন মন্তব্য করতে পারে না।
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, সাংবিধানিক পদে থেকে একদিন হঠাৎ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলে বসলেন, সংবিধানে পিআর পদ্ধতি নেই। তাই আগের নিয়মেই নির্বাচন হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিএনপির সুরে কথা বলছেন। আপনি সাংবিধানিক পদে থেকে এটা বলতে পারেন না। আমাদের কাছেও সংবিধান রয়েছে। সংবিধানের কোথায় নির্বাচন পদ্ধতি উল্লেখ নেই। তাই আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, আপনারা পিআরের পক্ষে গণভোটের ব্যবস্থা করুন। এ গণভোটের মাধ্যমে পিআর নিয়ে মতামত নিন। অধিকাংশ জনগণ যদি পিআর মানে তাহলে আপনাদেরও পিআর মানতে হবে। আর জনগণ যদি পিআর না মানে, তাহলে আমরা সেটা মেনে নেব। গায়ের জোরে দেশ শাষনের সময় শেষ হয়ে গেছে। এ বাংলাদেশ এখন আর সেই বাংলাদেশ নাই। বিরোধী দলকে দমন নিপীড়ন, আইন আদালতে মামলা দিয়ে দাবিয়ে রেখে আজীবন ক্ষমতায় থাকার দিন শেষ হয়ে গেছে।
প্রধান উপদেষ্টা প্রসঙ্গে জামায়াতের এ নেতা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা লন্ডনে গিয়ে একটি পার্টির দলের প্রধানের সঙ্গে মিটিং করেছেন। লন্ডনে বসে যুক্ত প্রেসব্রিফিং করেছেন। সেখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয়নি। নির্বাচনের ঘোষণা লন্ডনে বসে দিয়েছেন। দেশে ফিরে ঘোষণা দিতে পারতেন। তা ছাড়া জুলাই সনদ ঘোষণার সময় আপনি বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেননি। যার কারণে বিএনপি এ জুলাই সনদ ঘোষণায় খুশি।
গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা বুঝতে পারছি, রহস্যজনকভাবে একটি শক্তি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছে। সরকার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বজায় রাখতে পারছে না। তাই আমরা দাবি, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে তার ভিত্তিতেই জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। এখন একটি দল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বলছে, এ সংস্কারের আইনি ভিত্তি দেওয়ার কী প্রয়োজন। যত আইন সংস্কার করেন আমরা ক্ষমতায় গেলে তা মুছে দেব। তারা এখনই যদি এসব বলতে পারে তবে তাদের ইচ্ছার মধ্যে দুরভিসন্ধি আছে।
কেকে/ এমএস