ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট পতন ঘটে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের। মরণপণ সেই অভ্যুত্থানে পুরুষ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন সারা দেশের নারী শিক্ষার্থীরাও। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর হঠাৎ করেই দেশজুড়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানের আক্রান্ত হতে থাকেন নারীরা।
তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদসহ (ডাকসু) কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নানা ধরনের বুলিং ও হুমকির শিকার হচ্ছেন নারীরা। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার্থীদের নারীর প্রতি এমন বিদ্বেষপূর্ণ আচরণে ব্যাপক সমালোচানর ঝড় উঠেছে।
ডাকসুর বিভিন্ন প্যানেলের নারী প্রার্থীরা অভিযোগ করছেন, অনলাইনে তারা বিভিন্ন ধরনের হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষর্থীরাও একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন।
সম্প্রতি ডাকসুর এক নারী প্রার্থীকে গণধর্ষণের হুমকি দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। ফেসবুকে দেওয়া তার ওই বিদ্বেষপূর্ণ পোস্টে সমালোচনা যেমন করেছেন অনেকে, তার এমন বক্তব্যের সমর্থনেও কমেন্ট করেছেন বহু মানুষ। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আনিসুর রহমান মিলন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখ্দুম হল শাখা ছাত্রদলের সহসভাপতি। যদিও এ ঘটনায় সংগঠন থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর হেনস্তার ঘটনায় পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীর সঙ্গে বিরোধে জড়ান শিক্ষার্থীরা। যা এক পর্যায়ের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে বহু শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন।
এ বিষয়ে রাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী আছিয়া খাতুন বলেন, দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষার্থীরা নানা ধরনের হয়রানি, সাইবার বুলিং ও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এটি সামগ্রিক সামাজিক সংকট বলে মনে করি। একজন নারী শিক্ষার্থী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, যেখানে নারী শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নেই, সেখানে প্রকৃত শিক্ষার পরিবেশ কোনোভাবেই তৈরি হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘এখন একজন শিক্ষার্থী নিজের ঘরে থেকেও সাইবার বুলিং, হয়রানি ও নানা ধরনের অনলাইন আক্রমণের শিকার হতে পারে। নিরাপত্তা মানে এখন আর শুধু শারীরিক সুরক্ষা নয়, বরং ডিজিটাল বা অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও সমান জরুরি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইবার নিরাপত্তা সেল গঠন করা দরকার, যাতে অনলাইনে হয়রানির শিকার শিক্ষার্থীরা দ্রুত সহায়তা পান। নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তার সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক না কেন, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে কোনো দলীয় পরিচয় বা সামাজিক অবস্থান দিয়ে যেন কেউ দায়মুক্তি না পায়।’
ডাকসুর বামপন্থি সাতটি ছাত্রসংগঠন মিলে গঠিত প্যানেল প্রতিরোধ পর্ষদের ভিপি প্রার্থী শেখ তাসনিম আফরোজ (ইমি) জানান, ডাকসুর নারী প্রার্থীদের জন্য ভালো পরিবেশ নেই। তিনি বলেন, ‘অনলাইনে প্রচুর হ্যারাসমেন্ট হচ্ছি। আজেবাজে গালাগালি করা হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে আমি বলব, আসলে কোনো সংগঠনের নারী প্রার্থীদের জন্যই ভালো পরিবেশ নেই।’
এদিকে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেওয়া নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মানসুরা আলম। তিনি বলেছেন, ডাকসু নির্বাচনের প্রার্থী ফাহমিদা আলমকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও গণধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে। এটি অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ঘৃণিত আচরণ। তিনি বলেন, স্বৈরাচার পতনের পর যে বাংলাদেশ তৈরি হয়েছিল, আমরা নারীরা ভেবেছিলাম সেটি হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সমঅধিকারের রাষ্ট্র। কিন্তু আগস্টের পর আমরা এক মধ্যযুগীয় উপদ্রবের শিকার হয়েছি। নারীদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করার জন্যই বারবার আমাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে, সাইবার বুলিং করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘অতিদ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে নারীদের অধিকার ফিরিয়ে আনুন। নারীবিরোধী গোষ্ঠীর হাত থেকে নারীদের রক্ষা করুন।’
হাইকোর্টের আদেশে গত সোমবার ডাকসু নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পর আলী হোসেন নামের এক শিক্ষার্থী ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছেন, ‘হাইকোর্টের বিপক্ষে এখন আন্দোলন না করে আগে একে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পদযাত্রা করা উচিত।’ আলী হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র এবং সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক। এ বক্তব্যের মাধ্যমে আলী হোসেন বামজোট মনোনীত প্যানেলের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনবিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী বি এম ফাহমিদা আলমের উদ্দেশে হুমকি দেন। ফাহমিদা সম্প্রতি ছাত্রশিবির-সমর্থিত জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদের প্রার্থিতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন।
এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা তার ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘ফাহমিদার রিট করার অধিকার আছে। এজন্য তাকে গণধর্ষণের হুমকি দেওয়ার অধিকার নেই কারো। এমন ভাষা ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে অবশ্যই ডিউ প্রসেসে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
এ ঘটনায় গত বুধবার আলী হুসেনকে ৬ মাসের জন্য বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিষয়ক কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলাই-৩৬ আবাসিক হলে রাত ১১টার পর প্রবেশ করায় ৯১ ছাত্রীকে হল প্রাধ্যক্ষের অফিসে ডেকে পাঠিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় হল প্রশাসন। এ ঘটনায় তৈরি করা একটি ফটোকার্ডের নিচে ‘এগুলো ছাত্রী নয়, এগুলো বিনা পারিশ্রমিক যৌনকর্মী’ বলে অশালীন মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখ্দুম হল শাখা ছাত্রদলের সহসভাপতি আনিসুর রহমান মিলন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী।
মিলনের অশালীন মন্তব্যের বিষয়টি ছড়িয়ে পড়তেই বুধবার রাতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। ‘জুলাই ৩৬’ হলের সামনেই অনেক রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন ছাত্রীরা। একপর্যায়ে বুধবার রাতেই মিলনের পদ স্থগিত ও দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় ছাত্রদল। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে আরেক বিজ্ঞপ্তিতে মিলনকে আজীবন বহিষ্কারের কথা জানানো হয়।
জানা গেছে, মিলন খানের বিরুদ্ধে গতকাল মামলা করতে মতিহার থানায় অভিযোগ দিয়েছেন রাবি ছাত্রদল সভাপতি সুলতান আহমেদ রাহী। এ বিষয়ে মতিহার থানার ওসি আব্দুল মালেক বলেন, ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মাহবুবর রহমান বলেন, আমাদের নজরে ওই কমেন্টসহ অন্যান্য কমেন্টও এসেছে। আমরা ওই ছাত্রনেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেব।
কেকে/ এমএস