আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে পরিচিত রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। হাসিনার অপশাসনের অন্যতম রাজনৈতিক সঙ্গী ছিল এ দলটি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত ৩টি জাতীয় নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়া পেছনে জাপার একক ভূমিকা ছিল। ফলে অনেকের অভিযোগ, হাসিনাকে ফ্যাসিবাদ হয়ে ওঠার নেপথ্যে জাপার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। যার প্রধান ভূমিকা রেখেছে দলটির একাংশ ‘রওশনপন্থিরা’।
হাসিনার শাসনামলে জাপার রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় হাসিনা যখনই কোনো অন্যায় ও অবৈধ কাজকে বৈধতা দিতে চেয়েছেন, তার সবকটিতে সমর্থন জুগিয়েছে ‘রওশনপন্থিরা’। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এই তিনটি নির্বাচনকে বৈধতাও দিয়েছে জাপার এ অংশটি। তবে ৫ আগস্টের পর হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ দেশের রাজনীতিতে অবাঞ্ছিত ও তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলেও মাঠ চষে বেড়াচ্ছে জাপা। নির্বাচনের আগে দল গোছাতে তৎপর রয়েছে রওশনপন্থিরা।
সম্প্রতি জাতীয় পার্টির নতুন কমিটি করা হয়েছে। এতে জি এম কাদের ও তার অনুসারীদের বাইরে রেখে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে চেয়ারম্যান এবং এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব ঘোষণা করা হয়। এছাড়া কাজী ফিরোজ রশিদকে সিনিয়র কো. চেয়ারম্যান ও মুজিবুল হক চুন্নু নির্বাহী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। মূলত দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বিরোধীরা জাপার নামে এ কাউন্সিল করেছে। তবে জিএম কাদের নিযুক্ত মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এ কাউন্সিলকে অবৈধ আখ্যা দিয়েছেন।
তথ্য বলছে হাসিনার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী রওশনপন্থিদের নেতৃত্বেই এই কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর এর নেতৃত্বে রয়েছে হাসিনার শাসনামলের দোসর হিসেবে চিহ্নিতরা। যাদের হাত ধরেই আওয়ামী লীগ ফের সক্রিয় হওয়ার শঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, হাসিনা সরকারের সময়ে যত অপকর্ম ও অবৈধ নির্বাচন ছিল; তার সবকিছুর বৈধতা দিয়েছে জাপা। আওয়ামী লীগ মূলত এ দলটির ওপর ভর করেই ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল। আর এসবের মূলে ছিল রওশনন্থিরা।
এছাড়া দলটির অনেক নেতার অভিযোগ আওয়ামী লীগ যখনই কোনো অবৈধ কাজকে বৈধতা দিতে জাপাকে ব্যবহার করতে চেয়েছে, তখন দলটি একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা হাসিনার চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু রওশনপন্থিদের চাপে তাদের সেই দ্বিমত ধোপে টেকেনি। রওশন ও তার সঙ্গীরা দল ভাঙনসহ নানা নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে হাসিনাকে বৈধতা দিতে মরিয়া ছিল। এমনকি জাপার প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও এদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেননি। তাকেও নানাভাবে জিম্মি করে আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
জাপার এক সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা অনেক সিনিয়র নেতা আওয়ামী লীগের পাতানো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু রওশনপন্থিরা আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এমনকি প্রয়াত এরশাদ সাহেবও ওদের সামনে অসহায় ছিলেন।
জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান (কাদেরপন্থি) মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা খোলা কাগজকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির নামে যারা নতুন কমিটি করেছে, তারা মূল স্রোত থেকে বেরিয়ে গেছে। আর বাংলাদেশে কোনো দলের মূল স্রোত থেকে বেরিয়ে গিয়ে কেউ প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এটি জাতীয় পার্টির জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ নয়। এরা দলের জন্য জঞ্জাল ছিল। দলের মাথা বেঁচে এরা সরকারি দলের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত এবং তারা দলের জন্য ক্ষতিকারক ছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘এটি জাতীয় পার্টিকে দুর্বল করার জন্য একটি অপচেষ্টা মাত্র। এখন যারা নতুন কমিটি করছে; তারাই এক সময় শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছিল। তারা পরীক্ষিত দালাল। নতুন কমিটি করে তারা জাতির কাছে ক্ষমা চাইলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। তারা জাতীয় পার্টির নাম এবং একইসঙ্গে ছবিও ব্যবহার করছে, এ বিষয়ে আইনিভাবে মোকাবিলা হবে।’
দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য আল আমিন সরকার খোলা কাগজকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির নামে যারা নতুন কাউন্সিল করে নেতা হয়েছে, এরা সবাই শেখ হাসিনার আমলের ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের কুশীলব ছিল। ফলে এখনো তারা দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নতুন ফন্দি আঁটছে। তাছাড়া তারা তো আরো আগেই দল থেকে বহিষ্কৃত, সুতরাং মূল নেতৃত্বের বাইরে গিয়ে বহিষ্কৃতদের করা কাউন্সিলের কোনো আইনি ভিত্তি নেই।’
দলটির আরেক প্রবীণ নেতা অভিযোগ করে বলেন, হাসিনা সরকারের নীতিমালা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রওশন ও তার ঘনিষ্ঠরা অন্ধ সমর্থন দিয়েছে। এর ফলে জাপা নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান হারিয়েছে, পরিণত হয়েছে কেবল ‘দোসর’ হিসেবে। এখন তারা নতুন নেতৃত্ব তৈরি করে আবারো সেই ভূমিকা নিতে চাইছে।
এতদিন জি এম কাদেরের সঙ্গে থাকলেও অতিসম্প্রতি পদ হারিয়ে রওশনপন্থিদের ডেরায় ভিড়েছেন দলের সাবেক মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। গত শনিবার অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে নতুন কমিটির নির্বাহী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘দলের ভেতরে বিভক্তি, নেতৃত্বের সংকট এবং মনোনয়ন বাণিজ্যের মতো কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে তাতে সন্দেহ নেই।’ এ সময় দেশবাসীর কাছে নিঃশর্তভাবে ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি। চুন্নু বলেছেন, ‘গত প্রায় ৪ বছরে জাতীয় পার্টির মহাসচিব হিসেবে অনেক ভুল-ভ্রান্তি আমার থাকতে পারে, সেগুলো আপনারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। দেশবাসীর কাছে আমি একটি কথাই বলব আমরা রাজনীতি করতে গিয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে সব সময়ে হয়তো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। একটি কথাই বলব, আমরা দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কোনো বেআইনি কাজ করিনি। যদি নৈতিকভাবে ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে, সেই জন্য আজকের দিনে এই কাউন্সিলে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে আমরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাই।’
এর আগে নতুন কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে সংবাদ সম্মেলন করেন জাপার একাংশ (রওশনপন্থি) নেতারা। এতে ব্যারিস্টার আনিসুল জানান, গত ৩০ জুলাই ঢাকার একটি নিম্ন আদালতের আদেশে জাপার চেয়ারম্যানের সাংগঠনিক কার্যক্রমে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এর ফলে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম অনিশ্চয়তা ও স্থবিরতার মুখে পড়ে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, নির্বাচন কমিশনের সময়সীমা এবং জাপার মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বশূন্যতা গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক নয়। এ প্রেক্ষাপটে গঠনতন্ত্রের ২০(২)(খ) ধারা অনুযায়ী সাংগঠনিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৫ আগস্ট ব্যারিস্টার আনিসুলের সভাপতিত্বে প্রেসিডিয়াম সভায় সর্বসম্মতিক্রমে জাতীয় কাউন্সিল আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এরই প্রেক্ষিতে জি এম কাদেরের অংশের মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান বা প্রেসিডিয়াম মেম্বারকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগের বিধান আছে। কিন্তু জি এম কাদের দেশে আছেন, সুস্থ আছেন এবং নিয়মিত অফিসে আসেন। তিনি কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ করেননি। তাই এ প্রক্রিয়া অবৈধ। বহিষ্কৃতদের কাউন্সিলে মূলধারার কোনো নেতাকর্মী যাবেন না বলেও জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, শিষ্টাচারের কারণে বহিষ্কৃত নেতাদের কাউন্সিল থেকে বিরত থাকা উচিত। এ কাউন্সিল অবৈধ এবং রাজনীতিতে কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। জি এম কাদেরের নেতৃত্বে মূলধারার জাতীয় পার্টি টিকে থাকবে।
কেকে/ এমএস