মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য মুদ্রাস্ফীতি চলতি মধ্যে ৬.৫ থেকে ৭.০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা। মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নেমে না আসা পর্যন্ত নীতি সুদহার (পলিসি রেপো রেট) ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত থাকবে। তবে মূল্যস্ফীতির গতি সন্তোষজনকভাবে কমলে ধাপে ধাপে নীতি সুদহার কমানোর বিষয়টি বিবেচনায় আনা হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য এই মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে এ তথ্য জানানো হয়। এটি তুলে ধরেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক এজাজুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ও ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান।
ঘোষিত মুদ্রানীতি অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সম্পূর্ণ নমনীয় বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থা চালু করেছে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রার বিনিময় হার বাজারে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে, যা রফতানি ও রেমিট্যান্স উৎসাহিত করতে সহায়ক হবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে প্রক্ষেপণে বলা হয়েছে, ২০২৫ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৯৭ শতাংশ হতে পারে, যা সরকারের নির্ধারিত ৬.৭৫ শতাংশ লক্ষ্য থেকে অনেকটাই কম। তবে ২০২৬ অর্থবছরের জন্য ৫.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী মুদ্রানীতিক ও আর্থিক কৌশলগুলো নির্ধারিত হবে। ঘোষিত মুদ্রানীতিকে একটি বাস্তবমুখী ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যবসায়ীদের সংগঠন ডিসিসিআই বলেছে, ব্যবসায়িক পরিবেশের অনিশ্চয়তা, আইনশৃঙ্খলার অস্থিতিশীলতা, সীমিত জ্বালানি সরবরাহ এবং সর্বোপরি কঠোর মুদ্রানীতির কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি আরও তীব্র হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যদি মূল্যস্ফীতির হার আরো কমতে থাকে, তাহলে পলিসি রেপো রেট নিম্নমুখী হতে পারে। মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নেমে না আসা পর্যন্ত পলিসি রেপো রেট ১০ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকবে। স্টান্ডিং ল্যান্ডিং ফেসিলিটি (এসএলএফ) হার ১১.৫ শতাংশে থাকবে এবং স্টান্ডিং ডিপোজিট ফেসিলিটি (এসডিএফ) হার ৮.০ শতাংশ থাকবে। এই মুদ্রানীতি বিবৃতির (এমপিএস) প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতির হার আরো হ্রাস করা, বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা জোরদার করা।
তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যিক উত্তেজনা বৃদ্ধি ও নীতিগত অনিশ্চয়তা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মার্কিন প্রশাসনের সাম্প্রতিক শুল্ক বৃদ্ধি ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত অনিশ্চয়তা রফতানির জন্য ঝুঁঁকি তৈরি করছে, বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে এবং আর্থিক বাজারের অস্থিরতা বাড়াচ্ছে।’
গভর্নর বলেন, চাহিদা হ্রাস, মুদ্রার অস্থিরতা এবং হাইড্রোকার্বনের দাম হ্রাসের কারণে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো দুর্বল প্রবৃদ্ধি ও নিম্ন মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে সুদের হার কমাতে বা বর্তমান নিম্ন স্তরে স্থির রাখতে আগ্রহী হতে পারে। ২০২৫ এবং ২০২৬ সালে বিশ্ব বাজারে পণ্যের দাম হ্রাস পাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘২০২৪ সালের আগস্টে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ছিল। প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে ছিল ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অবমূল্যায়িত বিনিময় হার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, বৈদেশিক অর্থপ্রদানের বকেয়া বৃদ্ধি, কঠোর তারল্য অবস্থা, সুশাসনের অভাব এবং উচ্চ পরিমাণে নন-পারফরমিং লোন (এনপিএল)।’
তিনি বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সুস্পষ্ট ও ভবিষ্যৎমুখী কৌশল নির্ধারণ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর মুদ্রানীতির অবস্থান বজায় রেখেছে এবং একটি পূর্ণাঙ্গ বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থা চালু করেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাতকে লক্ষ্য করে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি শুরু করেছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরোপুরি নমনীয় বিনিময় হার বাস্তবায়নের উদ্যোগ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠনে সহায়তা করেছে। ব্যাংকিং খাতে জবাবদিহিতা ও সুশাসন ধীরে ধীরে ফিরে আসছে, আমানতকারীদের আস্থা ফিরেছে এবং তারল্য পরিস্থিতি কিছুটা সহজ হয়েছে।’
বিনিময় হার বিষয়ে গর্ভনর বলেন, ‘২০২৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক আরো নমনীয় বিনিময় হার ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হয়েছে, যাতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনা যায়। এ নমনীয় বিনিময় হার ব্যবস্থা বৈদেশিক ভারসাম্যহীনতা সহজে সামলাতে, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে চাপ কমাতে এবং রিজার্ভ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’
ড. মনসুর বলেন, ‘রফতানির চাহিদা হ্রাস এবং বাড়তি শুল্কের প্রভাবে সৃষ্ট নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই বিনিময় হার নমনীয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পদক্ষেপ। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিন দুইবার একটি রেফারেন্স এক্সচেঞ্জ রেট প্রকাশ করে, যা বাজারে মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে।’
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখায় ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগের পাশাপাশি সার্বিক শিল্পায়ন কার্যক্রমে স্থবিরতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২০২৫ সালের জুন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৬.৪ শতাংশে, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
ডিসিসিআই মনে করে, ব্যবসায়িক পরিবেশের অনিশ্চয়তা, আইনশৃঙ্খলার অস্থিতিশীলতা, সীমিত জ্বালানি সরবরাহ এবং সর্বোপরি কঠোর মুদ্রানীতির কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির এ নিম্নগতি আরো তীব্র হচ্ছে। এমতাবস্থায় খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৩ লাখ কোটি টাকা, যা মোট বকেয়া ঋণের প্রায় ২৭.০৯ শতাংশ, এটি আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি তৈরি করছে, সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন করছে বলে মনে করে ঢাকা চেম্বার।
ব্যবসায়িক আস্থার এ নিম্নমুখিতা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নীতিসুদ হার ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ডিসিসিআইর মতে, এ দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ সুদের হার বিশেষকরে ক্ষুদ্র, কুটির, ছোট ও মাঝারি শিল্প এবং উৎপাদনশীল খাতের ওপর অতিরিক্ত ঋণের ভার চাপিয়ে দিচ্ছে, যা অর্থনৈতিক গতিশীলতা ব্যাহত করছে। নতুন মুদ্রানীতিতে আগামী ছয় মাসের জন্য বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মাত্র ৭.২ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী নীতিতে ছিল ৯.৮ শতাংশ। এর বিপরীতে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ২০.৪ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে, যা অর্থনীতিতে আর্থিক চাপ বৃদ্ধি করবে, সেইসঙ্গে করদাতাদের ওপর বোঝা বাড়বে, পাশাপাশি বেসরকারি খাতের ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ আরো সংকুচিত করবে।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে সুদের হার হ্রাস এবং ঋণের শর্তাবলী সহজ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে ঢাকা চেম্বার, একইসঙ্গে সৎ ঋণগ্রহীতাদের পুনরুদ্ধারে সহায়তা এবং তাৎক্ষণিক খেলাপির ঝুঁকি এড়াতে ঋণ শ্রেণিবিন্যাসের সময়সীমা ছয় মাস বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে ডিসিসিআই আর্থিক খাতে কাঠামোগত সংস্কার, ঋণ বরাদ্দে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং তারল্য নিশ্চিত করতে কঠোর নজরদারির ওপর জোরারোপ করছে ঢাকা চেম্বার।
ডিসিসিআই-এর মতে, ভবিষ্যতে বিশেষ করে, বেসরকরি খাতের আস্থা পুনরুদ্ধার, বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য আরও নমনীয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও খাতভিত্তিক প্রতিক্রিয়াশীল মুদ্রানীতির কোনো বিকল্প নেই।
কেকে/ এমএস