২০২৪ সালের ৩১ জুলাই বাংলাদেশের সমসাময়িক ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে দেশজুড়ে পালিত হয় ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি, যার মূল উপজীব্য ছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পটভূমিতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, গণগ্রেফতার, নির্যাতন, হামলা, মামলা ও নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদ। এই আন্দোলন যেমন গণমানুষের অংশগ্রহণ ও প্রতিবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়াও তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ রূপ ধারণ করে।
আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত ও দাবিসমূহ : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের টেলিগ্রাম অ্যাপে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন আন্দোলনের পূর্ব সন্ধ্যায়। ঘোষিত ৯ দফা দাবির মধ্যে ছিল আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতাদের মুক্তি, গ্রেফতার হওয়া শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে মুক্তি, আন্দোলনকারী ছাত্রদের হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত এবং শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এসব দাবি প্রতিফলিত করে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা হতাশা, ক্ষোভ এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি ছাত্রসমাজের অনাস্থা।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পুলিশের ভূমিকা ও সহিংসতা : ৩১ জুলাই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করতে গেলে তাদের ওপর পুলিশ বলপ্রয়োগ করে। হাইকোর্ট, দোয়েল চত্বর, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী সব জায়গাতেই আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ, সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপসহ নানা ধরনের সহিংস উপায় অবলম্বন করা হয়। ঢাকায় অন্তত ৯০ জন আহত হন এবং শতাধিক আন্দোলনকারীকে আটক করা হয়। বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট ও হাইকোর্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর মনোভাব আন্দোলনকারীদের মধ্যে আতঙ্ক এবং ক্ষোভ আরো বাড়িয়ে তোলে।
মানবিক সহানুভূতি ও গণআকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ : আন্দোলনে শুধু ছাত্ররাই নয়, অনেক শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও আইনজীবীও অংশ নেন। হাইকোর্ট এলাকায় শিক্ষকদের উপস্থিতি, আইনজীবীদের মিছিল ও সমর্থন দেখিয়েছে যে, এই আন্দোলন সমাজের বিশুদ্ধ বিবেক ও মানবিকতা ধারণকারী শ্রেণিগুলোর কাছেও গ্রহণযোগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক লুৎফর রহমানের উপস্থিতি সেই বৈধতা আরো জোরদার করে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক চাপ : জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাঠানো এক চিঠিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রভাবশালী সিনেটর বেন কার্ডিন ও কোরি বুকার বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এসব আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে, বাংলাদেশে চলমান আন্দোলন শুধু অভ্যন্তরীণ ইস্যু নয়, বরং বৈশ্বিক মানবাধিকার ও গণতন্ত্র চর্চার অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিগোচর হয়। এছাড়া চলমান রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির আলোচনা স্থগিত করে। এটি বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে এক ধরনের চাপে ফেলে দেয় এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া : আন্দোলনের পটভূমিতে ৩১ জুলাই ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, আন্দোলনকারীরা ‘শ্রীলঙ্কা ধরনের সহিংসতা’ ছড়িয়ে দিয়ে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই বক্তব্য মূলত সরকার পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে, যা আন্দোলনকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের ছায়ায় দেখতে চায়। কিন্তু এটিই প্রশ্ন তোলে ছাত্রদের ন্যায্য দাবিকে সহিংসতার মোড়কে তুলে ধরার এ প্রয়াস আদৌ কি বাস্তবসম্মত, নাকি রাজনৈতিক ছল?
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়ে একটি মানবিক অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেন, যদিও তা আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ প্রশমনে কতটা কার্যকর হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
রাষ্ট্রীয় দমননীতি ও প্রশাসনিক রদবদল : ৩১ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে কোটা আন্দোলন কেন্দ্রিক ঘটনায় গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৭৩৫ জনে। রাজধানীতেই গ্রেফতার হন প্রায় ৩ হাজার। একই দিনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দায়িত্বে রদবদল আনা হয়; বিতর্কিত কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশীদকে সরিয়ে ডিবির নতুন দায়িত্ব দেন মহা. আশরাফুজ্জামানকে। যদিও এই পদক্ষেপ প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাভাবিক মনে হতে পারে, তবে আন্দোলনকারীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে এটি একটি চাপ মোকাবিলার কৌশল হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
নতুন কর্মসূচি ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা: ৩১ জুলাইয়ের সহিংস ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা পরদিন ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। এতে নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরতে চিত্রাঙ্কন, দেওয়াল লিখন, স্মৃতিচারণ এবং ডিজিটাল ফেস্টুন ব্যবহারের কথা বলা হয়। এটি একদিকে আন্দোলনের সাংস্কৃতিক দিককে উন্মোচন করে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় দমননীতির বিরুদ্ধে এক শান্তিপূর্ণ ও সৃজনশীল প্রতিবাদের রূপরেখা হাজির করে।
কেকে/ এমএস