নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা, ক্ষুধা, বাস্তুচ্যুত- এমন মর্মান্তিক বিশেষণগুলো যেন এখন শুধু গাজার জন্যই বরাদ্দ। গত ২১ মাস ধরে নারী-শিশু নির্বিশেষে উপত্যকাটির মানুষের ওপর চলছে বর্বর হত্যাযজ্ঞ। গাজায় যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চলছে তা একজন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে হজম করা বেশ কঠিন। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গাজায় কেবল ক্ষুধায় ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং এদের বেশিরভাগই শিশু বলে জানিয়েছে ভূখণ্ডটির হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ফিলিস্তিনি এ ভূখণ্ডে ত্রাণ সরবরাহে ইসরায়েলি বাধা নিয়ে অনেকদিন ধরেই জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার। তার মধ্যেই গত মঙ্গলবার ভূখণ্ডটিতে ক্ষুধায় মৃত্যু বাড়ার এ চিত্র এলো। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ডটিতে ক্ষুধা, অপুষ্টিজনিত মৃত্যু দাঁড়িয়েছে ১০১-এ, এর মধ্যে ৮০টিই শিশু বলে আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
লাখ লাখ মানুষ সেখানে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। যাদের খাদ্য নেই, থাকার জায়গা নেই। আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ নেই। এক অমানবিক ও মর্মান্তিক জীবন পার করছেন গাজাবাসী। তারা যেন এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছে। এ পর্যন্ত কত মানুষ নিহত হয়েছেন তার সঠিক কোনো হিসাব নেই। প্রতিনিয়তই মৃত মানুষের মিছিল ভারী হচ্ছে। তারা যে শুধু মানুষ মেরে ক্ষান্ত হচ্ছে তেমন নয়, কিছু মানুষকে চিহ্ন হিসাবে জীবিতও বাঁচিয়ে রাখছে। যাদের শরীরে রয়েছে ইসরায়েলি হায়েনাদের বর্বরতার দাগ।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) প্রধান ফিলিপে লাজারানি বলেছেন, এখন এমনকি সাহায্যকর্মীরাও ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছেন। ‘গাজায় ইউএনআরডব্লিউএ-র সহকর্মীসহ সেবাদানকারীদেরও এখন সেবা দরকার। চিকিৎসক, নার্স, সাংবাদিক, ইউএনআরডব্লিউএ কর্মীরাসহ ত্রাণকর্মীরাও এখন ক্ষুধার্ত। অনেকে দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন,” জেনেভায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে দেওয়া বিবৃতিতে বলেন লাজারানি।
গাজার পরিস্থিতিকে ‘দুনিয়ার নরক’ অ্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের কোথাও আর নিরাপদ জায়গা নেই। মে-র শেষ থেকে এ পর্যন্ত খাদ্য সাহায্য চাইতে গিয়েও এক হাজারের বেশি ক্ষুধার্ত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, বলছে ইউএনআরডব্লিউএ-র হিসাব। এদের অনেকে গুলিতে নিহত হয়েছে, অনেকে ত্রাণের ট্রাকের কাছে পৌঁছাতে গিয়ে হয়েছে পদদলিত।
যুদ্ধবিরতির আলোচনা ভেঙে পড়ার পর চলতি বছরের ২ মার্চ ইসরায়েল গাজায় পূর্ণাঙ্গ অবরোধ আরোপ করে এবং ভূখণ্ডটিতে সব ধরনের খাদ্য ও ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর মে-র শেষ থেকে সীমিত আকারে ত্রাণের ট্রাক ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়, তাও সবাই সেখানে ত্রাণ নিয়ে যেতে পারছে না।
কয়েকদিন আগে এক্সে দেওয়া এক পোস্টে ইউএনআরডব্লিউএ জানায়, গাজার বাইরে গুদামগুলোতে এখন যে পরিমাণ ত্রাণ মজুত আছে, তা দিয়ে ‘ভূখণ্ডটির পুরো জনসংখ্যাকে তিন মাস খাওয়ানো যাবে’, কিন্তু তাদেরকে ত্রাণ ঢোকানোর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। ঘাটতির কারণে গাজার ভেতরে এখন খাবারের দামও ৪০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে গেছে, বলেছে তারা।
ইসরায়েল বারবার বলে আসছে, তারা গাজায় ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি দিচ্ছে, কিন্তু হামাস ত্রাণ বিতরণে বাধা দিচ্ছে। তাদের এ দাবিকে ‘মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে গাজায় কর্মরত ত্রাণ সংস্থাগুলো।
আমি মৃত্যুকে দেখেছি : মোহাম্মদ আল-ইওয়াদি। গাজার ১৮ বছর বয়সি এই তরুণ তার চারপাশে কেবল মৃতদেহ আর আহত মানুষ দেখতে পাচ্ছিলেন। গত রোববার সকালে তিনি হাজারো ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনির সঙ্গে গাজা সিটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় আল-সুদানিয়া এলাকায় যাচ্ছিলেন। সেখানে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ত্রাণের ট্রাক আসার কথা ছিল। আল-ইওয়াদি ও অন্যদের জন্য দীর্ঘকাল বঞ্চিত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়ার এক বিরল সুযোগ হাজির হয়েছিল সেখানে।
প্রত্যক্ষদর্শী ইওয়াদি জানান, মানুষ যখন ট্রাকের কাছে জড়ো হওয়ার পর, ইসরায়েলি সেনারা তাদের ঘিরে ফেলে সরাসরি তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। লন্ডন থেকে পরিচালিত মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে তিনি বলেন, ‘তারা (ইসরায়েলি বাহিনী) ট্যাংক থেকে আমাদের ওপর ব্যাপক গুলি চালিয়েছে।’
ইসরায়েলি সামরিক যানগুলো ভিড়ের মধ্যে দিয়ে কীভাবে সাধারণ মানুষকে চাপা দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিল-সেই নির্মম অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে আল-ইওয়াদি। রোববারের এ হামলার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ইহাব আল-জেইন। তিনি বলেন, মানুষ যে তীব্র ক্ষুধা ও পানির অভাবে ভুগছে, তা তাদের তথাকথিত মানবিক ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলতে বাধ্য করছে। হতাশ হয়ে তিনি বলেন, তিনি শেষবার আটা পেয়েছিলেন এক সপ্তাহেরও বেশি সময় আগে, সম্ভবত দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে।
ইহাব আল-জেইন বলেন, ‘আমরা কী করব? এক কেজি আটার জন্য আমরা মৃত্যুর মুখে ছুটে যাচ্ছি এবং এমনকি তারপরও সব সময় কাজ হয় না। কখনো কখনো আমরা কিছুই না নিয়ে ফিরে আসি। আমরা মরি এবং খালি হাতে বাড়ি ফিরি।’ তিনি জানান, তিনি এর আগে একাধিকবার চেষ্টা করলেও ত্রাণকেন্দ্র থেকে কখনো কিছু সংগ্রহ করতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘এবার আল্লাহর রহমত ছিল। আমি নিজের চোখে মৃত্যু দেখেছি এবং কোনোভাবে বেঁচে ফিরেছি।’
জেইন তার ২০ সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বে আছেন। তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে- তার বাবা-মা, বোন, তার প্রয়াত ভাইয়ের দুই সন্তান, নিজের স্ত্রী এবং সন্তানরা রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তা কেবল আল্লাহই জানেন।’
জেইন জানান, তিনি আর এ বিতরণ কেন্দ্রে ফিরে যাবেন না। তিনি বলেন, ‘আমি ক্ষুধায় মারা যাব। এ ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি? সেখানে গিয়ে খুন হব? আমি আর ফিরে যাব না। বাচ্চাদের ক্ষুধায় মরতে দাও, এভাবে তাদের মরতে দেখার চেয়ে তা ভালো।’ তিনি বলেন, ‘দেড় ঘণ্টা ধরে আমার মাথার ওপর দিয়ে গুলি উড়েছে। গোলা ও গুলিবর্ষণ হয়েছে। আমি কীভাবে বেঁচে ফিরলাম তা কেবল আল্লাহই জানেন।’
দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান শতাধিক অধিকার গোষ্ঠীর : ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা ও কঠোর অবরোধের মধ্যে থাকা ফিলিস্তিনি ছিটমহল গাজায় অনাহারের বিস্তৃতি ঘটেছে। ভূখণ্ডটিতে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষুধায় ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে যাদের অধিকাংশই শিশু।
গতকাল বুধবার শতাধিক আন্তর্জাতিক দাতব্য ও মানবাধিকার সংগঠন এ পরিস্থিতি অবসানে বিশ্বের সরকারগুলোরকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তারা গাজায় অবিলম্বে ও স্থায়ী অস্ত্রবিরতি এবং মানবিক ত্রাণ সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে সব ধরনের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
রয়টার্স জানিয়েছে, এসব দাবি জানানো বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে ১১১টি সংগঠন। এসব সংগঠন সতর্ক করে বলেছে, গাজার সীমান্তে টন টন খাদ্য, পরিষ্কার পানি, চিকিৎসা সরবরাহ ও অন্যান্য উপকরণ স্পর্শহীন অবস্থায় পড়ে আছে, মানবিক সংস্থাগুলোকে ফিলিস্তিনি ছিটমহলটিতে প্রবেশ ও বিতরণ করার অনুমতি না দেওয়ায় তারা কিছুই করতে পারছে না। এদিকে পুরো গাজাজুড়ে ব্যাপক অনাহার ছড়িয়ে পড়ছে। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা সংস্থাগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মার্সি কোর, রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল ও নরওয়েজীয় রিফিউজি কাউন্সিল অন্যতম।
সংগঠনগুলো বলেছে, ‘ইসরায়েলি সরকারের অবরোধে গাজার জনগণকে অনাহারে রাখছে। ত্রাণ কর্মীরাও খাবার নেওয়ার জন্য একই লাইনে যোগ দিচ্ছে, শুধু তাদের পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে। সরবরাহ এখন পুরোপুরি শেষ। মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের নিজেদের সহকর্মী ও অংশীদারদের চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখছে। ইসরায়েল সরকারের সম্পূর্ণ অবরোধের মধ্যে বিধিনিষেধ, বিলম্ব খণ্ডিতকরণে বিশৃঙ্খলা, অনাহার ও মৃত্যু ঘটছে।’
কেকে/এআর