ওয়ারী এলাকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার প্রথম স্পোর্টিং ক্লাব ‘ওয়ারী ক্লাব’।
ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম ক্লাব কোনটি? প্রশ্নটি শুনলেই আমাদের মনে প্রথমেই আসে আবাহনী, মোহামেডান কিংবা ভিক্টোরিয়ার নাম। কিন্তু এ ক্লাবগুলোর অনেক আগে ওয়ারী এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার প্রথম স্পোর্টিং ক্লাব ‘ওয়ারী ক্লাব’।
ব্রিটিশ আমলে ফুটবল খেলায় ফরিদপুরের ভাদুড়ি পরিবারের খ্যাতি ছিল দেশজোড়া। এই পরিবারেরই এক কৃতি সন্তান রামদাস ভাদুড়ি ঢাকার ওয়ারী এলাকায় ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন একটি ক্রীড়া সংগঠন, যার নাম ছিল ‘ওয়েলিংটন ক্লাব’। দীর্ঘদিন চলার পর একসময় সংগঠনটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ওয়ারীর কয়েকজন ক্রীড়া সংগঠক এই ওয়েলিংটনকেই ‘ওয়ারী স্পোর্টিং ক্লাব’ নাম দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকার প্রথম ফুটবল ক্লাব। ১৮৯৮ সালে ‘ওয়ারী ক্লাব’ নামে সংগঠনটি শুরু হয়। স্থানীয় জমিদার সুরেন্দ্র নাথ রায় ক্লাবটির গোড়াপত্তনে মূল ভূমিকা রেখেছিলেন বলে মনে করা হয়।
বর্তমান (২০২৫ সাল) মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে ক্লাব পাড়ার গলি ধরে এগুলো প্রথমেই দেখা পাওয়া যায় মোহামেডান ক্লাবের। এরপরেই ভিক্টোরিয়া। আরেকটু সামনে হাঁটলে চোখে পড়ে ‘ওয়ারী স্পোর্টিং ক্লাবের’ মূল ফটক। তাতে প্রতিষ্ঠার সময়কাল লেখা ১৮৯৮। ক্লাবটির বয়স এখন ১২৭ বছর। সে হিসেবে ঢাকা শহর তো বটেই, এটি উপমহাদেশের প্রথম দিককার ক্লাবগুলোর মধ্যে একটি।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ক্রীড়া জগতে ওয়ারী ক্লাবের ছিল সাবলীল বিচরণ। খেলার মাঠে নানা চড়াই-উতরাই দেখেছে ক্লাবটি। কখনো জিতেছে, হেরেছে কখনো; কিন্তু বিশ্বাস হারায়নি। একসময় তো বড় বড় দলকে হারিয়ে জন্ম দিয়েছিল ‘ওয়ারী আইলো’র মত স্লোগান। তবে সেসব এখন সোনালি অতীত।
ছবি : সংগৃহীত
ওয়ারী স্পোর্টিং ক্লাব। রঙ তার লাল সাদা, স্লোগানে অভিনবত্ব-‘এক হৃদয় এক মন’। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে ক্রীড়া শুধুই বিনোদন ছিল না, ছিল আত্মমর্যাদা ও লড়াইয়ের প্রতীক। ওয়ারী ক্লাব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যও এসবের বাইরে ছিল না। এলাকার অভিজাতদের আড্ডার মূল জায়গা ছিল ক্লাব চত্বর, ক্লাবের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের মান-মর্যাদাও। তাই যেকোনো খেলায় সেরা দল গড়তে দুহাতে পয়সা খরচ করতেন তারা। তবে অন্যসব খেলার চেয়ে ফুটবলই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়।
ওয়ারী ক্লাবের প্রথম সাফল্য আসে ফুটবলে, ১৯১০ সালে। সে বছর ওয়ারী ক্লাব পরাজিত করে ব্রিটিশ রাজকীয় ‘প্রাসাদ’ দলকে। এ জয়ের মাধ্যমে উপমহাদেশের ফুটবল রসিকদের আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় ‘ওয়ারী ক্লাব’। এরপর ১৯১৭ সালে তৎকালীন লিগ চ্যাম্পিয়ন লিংকলিন ক্লাবকে হারিয়ে রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দেয় ক্লাবটি, হয়ে ওঠে নিয়মিত চর্চার বিষয়। এর বছর দুয়েক পরেই আরেকটি বড় সাফল্য পায় ওয়ারী ক্লাব।
ছবি : সংগৃহীত
১৯১৯ সালে তারা হারিয়ে দেয় মোহনবাগান ক্লাবকে! যে সময়ের কথা হচ্ছে, তখন মোহনবাগান শুধু বাংলা নয়, ভারত উপমহাদেশেরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লাব। ২-১ গোলে জেতা সে ম্যাচটি তাই ওয়ারী ক্লাবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে মনে করেন অনেকেই। ১৯২৫ সালে ভারত সফরে এসেছিলো ইংল্যান্ডের ক্লাব ‘শেরউড ফরেস্ট’। অনেক ভালো ফুটবল খেলেও ওয়ারী সেবার ২-১ গোলে হেরে যায়। তবে ওয়ারী ক্লাব শেরউডের জালে একবার হলেও বল ঢোকাতে সক্ষম হয়, যা পারেনি উপমহাদেশের অন্য কোনো দল।
বিশ্বখ্যাত কোরিনথিয়ান ফুটবল দল উপমহাদেশে সবসময় অপরাজিত থাকত। ১৯৩৭ সালে তাদের হারিয়ে দেয় যে ঢাকা একাদশ দল, সেই একাদশের ১০ জন খেলোয়াড়ই ছিল ওয়ারী ক্লাবের। প্রতিষ্ঠার পর ফুটবল দিয়ে শুরু করলেও এক সময় পাঁচটি আলাদা খেলায় অংশগ্রহণ করতে শুরু করে ওয়ারী। ফুটবল, হকি, ভলিবল, ক্রিকেট এবং টেবিল টেনিস। একে একে সাফল্য এসেছে প্রায় প্রতিটি খেলায়।
১৯৫৩ সালে ওয়ারী হকি দল লীগ শিরোপা জয়লাভ করে। সে বছর কলকাতায় খেলতে গিয়ে সেখানকার লিগ জয়ী মোহনবাগান হকি দলকে পরাজিত করে ১-৩ গোলে। এরপর হকিতে নানা সময়ে লিগ জিতেছে ওয়ারী। হকির মতই টেবিল টেনিসেও এসেছে নিয়মিত শিরোপা।
১৯৫৩ সালে পূর্ব-পাকিস্তান লিগে ক্লাবের খুরশিদ আনোয়ার ও আনোয়ার সামাদ হয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন। এ ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। টেবিল টেনিসের মতই ওয়ারী ভলিবল দল সবসময় শক্তিশালী ছিল। তাই তাদের সাফল্যেও এসেছে অনেক। ওয়ারীকে বলা হতো ভলিবল খেলোয়াড় তৈরির কারখানা। ৬০ ও ৭০ এর দশকে নিয়মিত লিগ বিজয়ী হতো ভলিবল দল।
১৯৮৫ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করে তারা। ক্রিকেটেও ক্লাবটির সাফল্য কম নয়। জাতীয় লিগে হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের রেকর্ড রয়েছে তাদের। বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলা অনেক প্লেয়ার উঠে এসেছে এই ক্লাব থেকে।