চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়টি দুর্নীতির আখড়ায় পরিনত হয়েছে। অনৈতিক সুবিধা ছাড়া কোনো ফাইলই ছাড়া হয় না এই দপ্তর থেকে। যেখানে প্রশাসনের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কর্মচারী পর্যন্ত সবাইকে বেতন ভাতা, পেনশনসহ সরকারি সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিল উত্তোলন সংক্রান্ত প্রয়োজনে গুনতে হয় বিশাল অঙ্ককের ঘুষ। একপ্রকার জিম্মি করে তাদের দাবি করা ঘুষ, চাহিদামতো দিতে ব্যর্থ হলে আপত্তি দাখিল অথবা বিল আটকে রাখাসহ নানা ভাবে হয়রানি করা হয় বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন এসব কাজে জড়িত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এ কে এম নজরুল ইসলাম ও হিসাব নিরিক্ষণ কর্মকর্তা রাজিব কুমার দত্ত।
এ কে এম নজরুল ইসলাম ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবরে ফটিকছড়িতে যোগদান করেন। অভিযোগ আছে, তদবির ও ঘুষের মাধ্যমে তিনি ফটিকছড়িতে বললি হয়ে আসেন। শুরু থেকেই কার্যালয়ের অডিট কর্মকর্তা রাজিব কুমার দত্তকে নিয়ে নিজ দপ্তরকে পরিণত করেন দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে। অর্থনৈতিক কারণে প্রশাসনের কাঠামোতে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার গুরুত্ব অনেক। তিনি ফটিকছড়িতে চলতি দায়িত্বের পাশাপাশি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার রাজস্থলী উপজেলায়ও অতিরিক্ত ২ দিন দায়িত্ব পালন করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোমবার ফটিকছড়ি সরকারি কলেজের ২৩ জন শিক্ষক-কর্মচারীর এরিয়ার বিলের ১ কোটি ৯ লাখ টাকা ছাড় দিতে হিসাব রক্ষণ কার্যালয়ে ৫% ঘুষ চান। বিষয়টি নিয়ে কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে কলেজের শিক্ষকদের বাগবিতন্ডা হয়। এটি পুরো উপজেলায় ওপেন সিক্রেট। পরে গোপনে ৪% হারে ঘুষ দিয়ে দাবির অর্থ অবমুক্ত করেন। এসব কাজে কার্যালয়ের হিসাব নিরিক্ষণ কর্মকর্তা রাজিব কুমার দত্ত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হন।
জানতে চাইলে কলেজের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা শিক্ষক মানুষ। কত টাকা বেতন পাই। ভুল বুঝাবুঝির এক পর্যায়ে কিছু ‘উপরি’ দিয়ে সন্ধ্যায় এসব অর্থ অবমুক্ত করি। আমাদের এ দেশ বুঝি আর মানুষ হবে না।’
কাঞ্চননগরের মিলন নন্দী নামে এক ভুক্তভোগী জানান, ‘যে কোনো কাজে গেলে টাকা লাগবেই। আমি চেক ছাড় করার জন্য কয়েকদিন ঘুরেছি। শেষ পর্যন্ত অফিসের রাজিবকে কিছু দিয়ে চেক ছাড় করেছি।’
একাধিক ভুক্তভোগী জানান, যেকোনো চেক ছাড় করার প্রক্রিয়ায় সেখানে ঘুষ দিতেই হয়। যদি কেউ দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে তার কাজও আটকে দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে মানুষকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুষ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে এই কার্যালয়ে।
প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, অফিসিয়াল ও ভাউচার বিলের ৫ পারসেন্ট হারে টাকা দাবী করেন রাজিব। পরে তাকে ৪ পারসেন হারে টাকা দিতে হয়েছে। চাহিদা মতো দিতে না পারায় একবার বেতন আটকিয়ে রেখেছিলেন।
সরকারি এক কর্মচারী নাম গোপন রেখে বলেন, মে মাসের ২৪ তারিখে বেতন সাবমিট করি। একাউন্ট অফিসের উদাসিনতার কারণে এপ্রিল মাসের ৫ তারিখে বেতন আসলেও কার্যালয়ের কর্মচারীরা বেতন পাননি। ইচ্ছে করেই তারা বেতন আটকিয়ে রাখছে।
শিক্ষা কার্যালয়ের একজন বলেন, গত মাসের অফিসিয়াল বিল ভাউচারের টাকা থেকে অডিটর রাজিব ৫ পারসেন্ট দাবি করে বসেন। দাবিকৃত টাকা না দেওয়ায় স্টাফদের বেতন ফরওয়াডিং করেননি। এছাড়াও অফিসিয়ালি যে কোন বিল নিয়ে গড়িমশি করেন তারা।
কিছুদিন আগে উর্ধ্বতনদের দপ্তরে তাদের বিষয়ে অভিযোগ করেছিলেন শিক্ষকরা। অভিযোগে লিখেছিলেন, জিপিএফ হিসাব নম্বর খোলা, বেতন নির্ধারণ, বকেয়া বিল, জিপিএ চূড়ান্ত বিলসহ কোনোকিছুই মোটা অঙ্কের উৎকোচ ছাড়া স্বাক্ষর করেন না তারা। শিক্ষকদের বিভিন্ন বিল পাস করতে নানা অজুহাতে সেখানে টাকা নেন। ২২৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্লিপের বিলপ্রতি ৫০০ টাকা করে দাবি করেন। টাকা না দিলে শিক্ষকদের হুমকিও দেন। এছাড়া পেনশন ও আনুতোষিক বিলে ১৫-২০ হাজার করে নেন।
প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ওই কর্মকর্তা ও কার্যালয়টি শিক্ষকদের বিভিন্ন সময় হয়রানি করেন। তাদের মোটা অঙ্কের উৎকোচ দেয়া ছাড়া শিক্ষকদের কোনো কাজই হয় না। করেন না।’
অভিযুক্ত হিসাব নিরিক্ষণ কর্মকর্তা রাজিব কুমার দত্ত বলেন, ‘কলেজের বিষয়ে অফিসের প্রধানের সাথে কি হয়েছে আমি জানিনা। আমি কোনো ঘুষ লেনদেনে জড়িত নই। কেউ কেউ আমাকে চা নাস্তা খাওয়ার জন্য দু-একশ টাকা দিয়ে থাকেন হয়ত।’
উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এ কে এম নজরুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘কলেজের বিষয়টি দ্রুতই অর্থ ছাড় দিয়েছি। কোনো গাফিলতি করিনি। আটকিয়ে রাখিনি। অভিযোগ থাকলে ডিপার্টমেন্ট দেখবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার অনিয়মের বিষয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে দূর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানির কোনো সুযোগ নেই।’
কেকে/ এমএস