ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ছলিমাবাদ ইউনিয়নের সাহেবনগর গ্রামের মরহুম আব্দুল খালেকের বড় ছেলে ডা. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ডাক্তার হয়ে বাবার স্বপ্নপূরণ করেছি, এখন গ্রামের মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতে চাই।
আমার বাবা নিজে তেমন একটা লেখাপড়া করেননি। সেটা নিয়ে তার আজীবন আক্ষেপ ছিল। তাই নিজের সন্তানের বেলায় তিনি ভুল করতে চাননি। আমাকে ঠিক সময়ে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। আমাদের গ্রাম থেকে সেবার আমিই একমাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। বলাবাহুল্য আমার প্রাইমারি স্কুল ও হাই স্কুলে আমার ক্লাসে আমাদের গ্রাম থেকে আমিই একমাত্র ছাত্র ছিলাম এবং সব ক্লাসেই আমি প্রথম স্থান অধিকার করতাম। ফলে গ্রামের আর আট-দশজনের মতো আমার শৈশব কাটেনি। নিজের অজান্তেই আমি এলাকায় ভালো ছাত্র হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়ে যাই। অনেকে বলে থাকে বাঙালিরা অনেক পরশ্রীকাতর।
কিন্তু আমার বেলায় আমি সেটা দেখিনি, আমার এলাকাবাসী আর আমার প্রাইমারি ও হাই স্কুলের শিক্ষকবৃন্দের কাছ থেকে আমি যে ভালোবাসা ও স্নেহ মমতা পেয়েছি তা অকৃত্রিম, অপরিসীম, কোনো কিছু দিয়ে তা পরিশোধ করা যায় না। ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম ডাক্তার হব, যদি পারি এলাকার মানুষের ভালোবাসা ও স্নেহের ঋণ পরিশোধ করব। ওই স্বপ্ন ছিল বাবার দেখানো স্বপ্ন। স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তবে কষ্ট হয়েছে অনেক। আল্লাহ আমার মনের আশা পূরণ করেছেন। সকল অনুপ্রেরণা দিয়েছেন আমার মা- বাবা, ভাই-বোন ও আমার চাচা মরহুম ছিদ্দিকুর রহমান। আমার বাবা আমার কাছে সব।
তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৮৫ সালে এমবিবিএস শেষ করেছেন। বর্তমানে নিজেদের গড়া বাঞ্ছারামপুর সদরে ঐতিহ্যবাহী সেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ডা.রাজ্জাকসহ তারা ৫ ভাই। তিনি সবার বড়। ২য় জন আবদুল করীম ব্যবসায়ী, ৩য় জন ডিবিসি টিভিতে কর্মরত, ৪র্থ আবদুর রব বাঞ্ছারামপুর সেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সবার ছোট ওয়াসিম একই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রেডিয়োলজির দায়িত্বে আছেন।
ডা. আবদুর রাজ্জাক বাঞ্ছারামপুর সরকারি এস এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং ১৯৭৮ সালে রংপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচ এস সিতে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
ডাক্তার হয়ে তার প্রথম কর্মস্থল ছিলো বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা সরকারি হেল্থ কমপ্লেক্সে। ১৯৯০ সালে সরকারি চাকুরী ছেড়ে সরকারি ভাবে ইরানে চলে যান।১৯৯৬ সালে ফিরে এসে ২ বছর থেকে আবার চলে যান সৌদি আরব।
সর্বমোট ২৬ বছর কাজ করেন রিয়াদে। প্রায় আট বছর কাজ করেন সরকারি আল্-ইয়ামামা হাসপাতালে রেসিডেন্ট পেডিয়েট্রিক সার্জন হিসেবে।
তারপর প্রায় আঠারো বছর তিনি জেনারেল ও ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি রেজিস্ট্রার হিসেবে অত্যাধুনিক হাসপাতাল, রিয়াদ কেয়ার হাসপাতালে কাজ করেন। ডা. আবদুর রাজ্জাক বলেন, যখনই সুযোগ পাই বাড়িতে যাই তখনই গ্রামের অসহায় মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেই। এবারও ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে বহু অসহায় মানুষকে ফ্রি চিকিৎসা দিয়েছি। বলেছি আমার মা ও মৃত বাবার জন্য দোয়া করতে। এছাড়া আমার কিছু চাওয়ার নেই।
তিনি আরো বলেন, আমি ভালো চিকিৎসক হওয়ার আগে একজন ভালো মানুষ হতে চেয়েছিলাম।হতে পেরেছি কিনা জানি না। সব সময় চেষ্টা করব অসহায় মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে। আমি আমার এলাকায় মানুষের জন্য আজীবন ফ্রি সেবা দিতে চাই।
ডা. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ভর্তির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে আমার চাচা মরহুম ছিদ্দিকুর রহমানের কর্মস্থল রংপুরে চলে যাই। সেখানে রংপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। আমার মরহুম আব্বা তার জমি বিক্রি করে মেডিকেল কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় বেশ কয়েকবছর আমি আমার চাচার বাসায় ছিলাম। পরিবারের যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন সকলের কাছে আমি চির ঋণী।
ডা. রাজ্জাকের মা জোহরা খাতুন বলেন, ছেলে যখন বাড়িতে আসে তখন এলাকার বিভিন্ন মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে বাড়িতে। অনেকে টাকা দিতে চায় আমি তাদের বলি- আমার ছেলে ফ্রি চিকিৎসা দেয় টাকা নেয় না। অনেকে বলে রাজ্জাকের দেয়া ওষুধ খেয়ে আমি সুস্থ হয়ে গেছি। তখন গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়। আমার আল্লাহর কাছে আর কিছু চাওয়া নেই। আমার স্বপ্ন পূরণ করেছে রাজ্জাক।
স্থানীয় ছলিমাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার মো.ওমর ফারুক বলেন, শুনেছি অনেক কষ্ট ও পরিশ্রম করে এখন ডাক্তার হয়েছে রাজ্জাক ভাই । ছুটিতে বাড়িতে আসলে এলাকার মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়। সবাই ডা. রাজ্জাককে ভালোবাসে।
কেকে/এএস