প্রতিদিন সূর্য ওঠে, আবার ডুবে যায়—ঠিক তেমনই একজন বাবা নীরবে প্রতিদিন ঘুম ভাঙার আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান এবং যখন সন্তানের চোখে ঘুম নেমে আসে, তখন তিনি ফিরেন। এ আসা-যাওয়ার মাঝেই জমা হয় শত সহস্র স্বপ্ন, দায়, দায়িত্ব আর সীমাহীন ত্যাগ। বাবা কোনো কবিতার বিষয় নন, কোনো উপন্যাসের নায়ক নন—তবুও তিনি একজন জীবন্ত উপাখ্যান, একটি চলমান মহাকাব্য।
তিনি বলেন না ‘আমি ভালোবাসি’, তিনি দেখান না চোখের জল। কিন্তু তিনি আমাদের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বোঝা কাঁধে তুলে নেন—এবং সেটা করেন এমন নিঃশব্দে, যেন কিছুই হয়নি। সন্তানরা বড় হয়, নিজের জীবন গড়ার পথে হাঁটে, অথচ বাবা তখনো একাই দাঁড়িয়ে থাকেন পেছনে—ভাঙা স্যান্ডেল পায়ে, কাঁধে একটা পুরোনো ব্যাগ আর মনে গাঁথা সন্তানের স্বপ্নের তালিকা।
যাদের বাবা এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন, তাদের জন্য শ্রদ্ধা ও দোয়া হলো সন্তানের সেরা উপহার। আজ একটি সূরা ফাতিহা পাঠ করুন তার রুহের মাগফিরাতের জন্য। একফোঁটা অশ্রু ঝরান তার স্মৃতিতে—সেই অশ্রু কিয়ামতের দিন সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে আপনার ভালোবাসার। বাবার ভালোবাসা কোনো দিনে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি আছেন প্রতিটি সকালে আমাদের কাজে যাওয়ার প্রেরণায়, আছেন প্রতিটি রাতের ক্লান্তিতে বিশ্রামের ছায়া হয়ে। তাকে মনে রাখুন প্রতিদিন।
আল্লাহতায়ালা কুরআনে পিতামাতার অধিকার নিয়ে বলছেন—“তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তুমি কেবল তাঁরই ইবাদত করো এবং পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো। তাদের একজন বা উভয়েই যদি বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তাদের ‘উফ’ পর্যন্ত বলো না, তাদের ধমক দিয়ো না এবং তাদের সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে কথা বলো।” (সূরা আল-ইসরা : ২৩)।
এ আয়াতে পিতার গুরুত্ব এতটাই উচ্চে তোলা হয়েছে যে, তার প্রতি বিরক্তির সামান্যতম ইঙ্গিত—‘উফ’ শব্দটিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ আমরা এমন সন্তান, যারা বাবার কণ্ঠে কিছুটা কড়াকড়ি শুনলেই মুখ কালো করি, ফোন কেটে দিই, অথবা সপ্তাহের পর সপ্তাহ খোঁজ না নিয়ে পার করে দিই।
নবি করিম (সা.)-এর এক হাদিসে এসেছে—‘তোমার পিতা তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম।’ (তিরমিযি)। অর্থাৎ, একজন বাবার সন্তুষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সন্তানের চূড়ান্ত পরিণতি। বাবা সন্তুষ্ট হলে জান্নাতের দ্বার খুলে যেতে পারে, আর তার অসন্তুষ্টিতে মানুষ ঠেলে যেতে পারে জাহান্নামের অন্ধকারে। এত বড় পরিণতি, অথচ বাবাকে নিয়ে আমাদের চিন্তাটুকু যেন কেবল একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস, একটি উপহারে সীমাবদ্ধ।
বাবা হচ্ছেন সেই মানুষ, যিনি জীবনের প্রতিটি সিঁড়িতে আমাদের হাত ধরে উঠিয়েছেন, অথচ এক সময় সেই হাতটা আমরা ধরতে লজ্জা পাই। বাবা মুখে বলেন না, ‘আমার কিছু প্রয়োজন’, কিন্তু তিনি জানেন, সন্তানের প্রয়োজনই তার সবচেয়ে বড় চাওয়া। তিনি নিজে না খেয়ে থাকেন, কিন্তু সন্তানের মুখে হাসি থাকলেই তার ক্ষুধা মরে যায়।
শহরের প্রতিটি অলিতে গলিতে এমন হাজারো বাবা আছেন, যারা ভাঙা শরীর নিয়ে রিকশা চালান, শ্রম দেন, চাকরি করেন, ব্যবসায় লোকসান সইলেও মুখে হাসি রাখেন—শুধু সন্তানের খরচটা ঠিকমতো পাঠাতে পারবেন কিনা, এ চিন্তায়।
সন্তান যখন ব্যর্থ হয়, প্রথম যে চোখে অশ্রু জমে ওঠে, তা বাবার। কিন্তু তিনি কাঁদেন না। তিনি হয়তো রাতের আঁধারে তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে—সৃষ্টিকর্তার কাছে সন্তানের তৌফিক কামনায় হাত তোলেন। তার এ দোয়ার মূল্য এক জীবনের সম্পদের চেয়েও বড়।
আজ বাবা দিবস। অনেকেই উপহার দেবেন, ফেসবুকে ছবি পোস্ট করবেন, হয়ত একসঙ্গে খেতেও যাবেন। এগুলো নিশ্চয়ই ভালো, প্রশংসনীয়। কিন্তু আপনি কি কখনো তার চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন, ‘বাবা, আমি আপনাকে ভালোবাসি?’ এই একটি বাক্য, হয়ত তার সারা জীবনের ক্লান্তি মুছে দিতে পারে। তার শূন্য হয়ে আসা চোখে ফিরিয়ে আনতে পারে জ্যোতি।
আর যাদের বাবা এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন, তাদের জন্য শ্রদ্ধা ও দোয়া হলো সন্তানের সেরা উপহার। আজ একটি সূরা ফাতিহা পাঠ করুন তার রুহের মাগফিরাতের জন্য। একফোঁটা অশ্রু ঝরান তার স্মৃতিতে—সেই অশ্রু কিয়ামতের দিন সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে আপনার ভালোবাসার।
বাবার ভালোবাসা কোনো দিনে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি আছেন প্রতিটি সকালে আমাদের কাজে যাওয়ার প্রেরণায়, আছেন প্রতিটি রাতের ক্লান্তিতে বিশ্রামের ছায়া হয়ে। তাকে মনে রাখুন প্রতিদিন। কারণ বাবা হচ্ছেন সেই মানুষ, যাকে ভালোবাসার জন্য কোনো আলাদা উপলক্ষ্যের প্রয়োজন হয় না—তিনি নিজেই একটি উপলক্ষ্য।
লেখক : কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর
কেকে/এএম