দেশে হাতেগোনা কয়েকটি দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ ‘নাগলিঙ্গম’ টিকে আছ। এরমধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় ২টি নাগলিঙ্গম গাছে ফুল আসার তথ্য পাওয়া গেছে। একটি জেলার শ্রীমঙ্গলস্থ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) এবং অন্যটি একই উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের শহরশ্রী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত নৌ কর্মকর্তা দেওয়ান গউছউদ্দিন আহমদের বাড়িতে।
দেশের বিরল প্রজাতির একটি ফুল, নাগলিঙ্গম এখন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায়। এই ফুলটি তার অদ্ভুত সৌন্দর্য এবং মিষ্টি গন্ধের কারণে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, বিটিআরআই এর ভবনের পুকুরের পাশে বিশাল নাগলিঙ্গম বৃক্ষটি ফল ও ফুলে ভরপুর। গাছটি তার বিশাল আকৃতি ও অপরূপ ফুলে পুরো ক্যাম্পাসে সৌরভ ছড়াচ্ছে। গাছের ফুলের রং গোলাপি ও হালকা হলুদ মিশ্রিত, যার সৌরভে গোলাপ এবং পদ্মের মিষ্টি গন্ধের সংমিশ্রণ রয়েছে। এই ফুলের পরাগচক্র সাপের ফণার মতো বাঁকা হওয়ায় এর নাম ‘নাগলিঙ্গম’ রাখা হয়েছে। চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে ফুল দেখতে আসা অনেকেই এই বিরল ফুলের সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দি করছেন।
নাগলিঙ্গম গাছের বিশেষত্ব হলো এটি গাছের নিচ থেকে গাছের সমস্ত শরীর জুড়ে ফুল ফোটে। এমন দৃশ্য অনেক দর্শনার্থীকে মুগ্ধ করেছে।
রাজশাহী থেকে আসা এক দর্শনার্থী তাসলিমা জাহান বলেন, ‘এমন ফুল এর আগে কখনো দেখিনি। এই গাছের ফুল গাছের গুঁড়ি থেকে ফোটে, যা সত্যিই অসাধারণ।’
একইভাবে শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আশিকুর রহমান চৌধুরী জানান, এত সুন্দর ফুল আগে কখনো দেখিনি, আর এই গাছের সৌন্দর্য সত্যিই চমৎকার।
নাগলিঙ্গম গাছটির বয়স প্রায় ৩২ বছর। এটি ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ আল হোসেন রোপণ করেছিলেন। বিটিআরআই’র পুকুরপাড়ে অবস্থানকারী এই গাছটি এখন বিশাল আকার ধারণ করেছে। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে একসাথে ফুল ও ফল দেখা যায়। এই গাছটির ফুল শুকিয়ে বাদামী-খয়েরি রঙের গোলাকার ফল ধারণ করে।
এদিকে, মির্জাপুর ইউনিয়নের শহরশ্রী গ্রামে অবসরপ্রাপ্ত নৌ কর্মকর্তা দেওয়ান গউছউদ্দিন আহমদের বাড়িতে অবস্থিত নাগলিঙ্গম গাছও ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। তার বাড়ির আঙিনায় ফুল ফুটতে শুরু করেছে এবং পর্যটকরা সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন। দেওয়ান গউছউদ্দিন আহমদ জানান, প্রায় ১৫-১৬ বছর ধরে গাছটি ফুল দিচ্ছে এবং এবছর বিশেষভাবে বেশি ফুল ফুটেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা নাগলিঙ্গম গাছ সম্পর্কে তার বই ‘শ্যামলী নিসর্গ’-এ উল্লেখ করেছেন যে, নাগলিঙ্গম গাছের আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণ মণ্ডলে। এটি একটি চিরহরিৎ বৃক্ষ, যেটি বছরে একাধিকবার নতুন পাতা গজায় এবং ফুল ফোটে। এর ফুলের সৌরভ এবং গাছের বিশাল আকার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক উদ্ভিদবিজ্ঞানী ড. ইসমাইল হোসেন বলেন, পৃথিবীতে এ গাছ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। নাগলিঙ্গম এক প্রকার বিশাল বৃক্ষ, যার ফুলের নাম নাগলিঙ্গম ফুল। এর ইংরেজি নাম ‘ক্যানন বল’। নাগলিঙ্গমের আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বনাঞ্চল। এই গাছে ফুল ধরার পর বেলের মতো গোল গোল ফল ধরে। এগুলো দেখতে কামানের গোলার মতো। বিরল প্রজাতির ফুলটির সৌরভে রয়েছে গোলাপ আর পদ্মের সংমিশ্রণ। নাগলিঙ্গম গাছ ৩৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। গুচ্ছ পাতাগুলো খুব লম্বা, সাধারণভাবে ৮ থেকে ৩১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। বছরের প্রায় সব ঋতুতেই এই গাছের পাতা ঝরে এবং কয়েক দিনের মধ্যে আবার নতুন পাতা গজায়। দ্রুত বর্ধনশীল নাগলিঙ্গমগাছে চারা রোপণের ১২-১৪ বছর পর গাছে ফুল ধরে। গাছের কাণ্ড ভেদ করে বেরিয়ে আসে প্রায় ৭ ইঞ্চি দীর্ঘ অসংখ্য মঞ্জুরি। এক একটি মঞ্জুরিতে ১০-২০টি ফুল ক্রমান্বয়ে ফুটতে থাকে। মঞ্জুরির একদিকে নতুন ফুল ফোটে, অন্যদিকে পুরাতন ফুল ঝরে পড়ে। ফুলের রঙ অনেকটা লালচে কমলা বা লালচে গোলাপি হয়ে থাকে। এই ফুলের ওষুধী গুণাগুণ আছে বলেও জানা যায়।
কেকে/ এমএস