চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে আলোচনা যখন নতুন মাত্রা পেয়েছে, তখন রাজপথে এক নতুন ঘোষণা দিয়েছেন বামপন্থিরা—রোডমার্চ। তারা বলছেন, বন্দরের নিয়ন্ত্রণ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। এ বক্তব্য হয়ত মূলধারার মিডিয়ায় কেন্দ্রস্থলে নেই, তবে ভেতরে ভেতরে বহু মানুষের ভেতর তা সাড়া জাগিয়েছে। বলা চলে এটা নীরব সমর্থন। অর্থাৎ যারা সরাসরি ২৭-২৮ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চে অংশ নিচ্ছেন না, তারাও মনে মনে বলছেন, ‘ঠিক তো বলছে।’ এটা একটি ভিন্ন ধাঁচের সমর্থন গড়ে উঠছে—নীরবতা, উদ্বেগ, ও সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিব্যক্ত হওয়া বিতর্ক— সবই এ আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ। আমরা দেখছি, মানুষের ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে অন্য উপায়ে নতুন ধারার ‘ডিজিটাল ডিসসেন্ট’ এবং কৌশলগত একাত্মতা।
প্রথাগত রাজনীতিতে কোণঠাসা হলেও বাংলাদেশের বামপন্থিরা বারবার সামাজিক দায়বদ্ধতার ইস্যুতে রাজপথে থেকেছেন। এর আগে তারা সুন্দরবন রক্ষায়, বিবিয়ানা গ্যাস রক্ষায়, কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী আন্দোলনে রোডমার্চ করেছেন। তাদের পক্ষে কখনো আদালত দাঁড়ায়নি, পুঁজিপতিদের মিডিয়া কখনো তাদের আওয়াজ প্রচার করেনি, তবু তারা রাস্তায় থেকেছেন। এবারের রোডমার্চও তেমনই—স্বরলিপি ছাড়া গাওয়া এক গণসংগীত।
এ লড়াই কেবল বামপন্থিদের নয়। এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের। যে রোডমার্চ আজ কিছু সংখ্যক মানুষ করছেন, কাল তা হতে পারে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন।
চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি বন্দর নয় এটি আমাদের রাষ্ট্রের শেষ সীমানা। একে হারানো মানে কেবল রাজস্ব নয়, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অধিকারও বিসর্জন দেওয়া।
ড. ইউনূস হোক বা দাতাগোষ্ঠী যারাই বলুক, ‘বিদেশিরা পারে’—আমাদের জবাব হওয়া উচিত, ‘আমরাও পারি, যদি রাষ্ট্র চায়।’
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবাহের হৃৎপিণ্ড। বছরে প্রায় ৩০০০ জাহাজের আগমন-প্রস্থান এবং দেশের মোট বাণিজ্যের ৯০% এর অধিক এ বন্দর দিয়েই সম্পন্ন হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বন্দর সরকারকে হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব দিয়েছে। অর্থাৎ এটি লাভজনক, সফল এবং সক্ষম একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। তবুও প্রশ্ন উঠছে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে কেন বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব উঠছে?
২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন, বাংলাদেশের বন্দরসহ অবকাঠামো উন্নয়নে বিদেশি কোম্পানিকে আনা উচিত। তার যুক্তি ছিল—বিদেশিরা দক্ষ, তারা ব্যয় কমিয়ে উন্নয়ন ঘটাতে পারে। এ বক্তব্য আজও ঘুরে ফিরে আসে, যখন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতারা সরকারকে চাপ দেয় ‘বিদেশি কোম্পানিকে দিন, আপনার উন্নয়ন ঘটবে।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, উন্নয়ন কাদের জন্য? যে লাভ বাংলাদেশের জনগণের, তা যদি অন্য রাষ্ট্র বা কোম্পানির পকেটে যায়, তবে সে উন্নয়নের মূল্য কে দিচ্ছে? শুধু দক্ষতা নয়, বন্দর নিয়ন্ত্রণ মানে কৌশলগত ভূ-অবস্থান, সামরিক গুরুত্ব, এবং স্থানীয় শ্রমবাজারের ওপর কর্তৃত্ব। এসব হাতছাড়া হওয়ার অর্থ, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার অন্যতম ‘প্রবেশদ্বার’ অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার হাম্পানটোটা বন্দরের কথা আজ বিশ্বজুড়ে আলোচিত। চীনের কাছ থেকে নেওয়া বিশাল ঋণ শোধ করতে না পেরে ২০১৭ সালে বন্দরটি চীনা কোম্পানির কাছে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দিতে বাধ্য হয় শ্রীলঙ্কা। আজ তা শুধু একটি বন্দর নয়, বরং সার্বভৌমত্ব হারানোর প্রতীক। বাংলাদেশ কি একই পথে হাঁটছে? আমাদের করপোরেট উন্নয়নের স্বপ্ন একদিন আমাদেরও কি ইজারার পথে ঠেলে দেবে? কৌশলগত ভুল সিদ্ধান্ত একবার নিলে, তা শুধরানো সম্ভব হয় না। উন্নয়নের নামে বা করপোরেট দক্ষতার লোভে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ হারানোর চড়া মূল্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিতে হয়।
বামপন্থিদের রোডমার্চ কেবল শ্রমিক অধিকারের ইস্যু নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের আত্মপরিচয়, নিয়ন্ত্রণ এবং ‘কাকে উত্তরদায়ী’—এ মৌলিক প্রশ্নগুলোকে সামনে নিয়ে আসছে। এমন এক সময় যখন দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো বন্দর ও কৌশলগত স্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নিতে তৎপর, তখন বাংলাদেশের বামপন্থিদের এই রোডমার্চ একটি প্রতিরোধের ভাষা। রোডমার্চে শিক্ষার্থী, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিচ্ছেন বটে, তবে সেই অংশটি যে খুব বেশি তা বলা যাবে না। তা সত্ত্বেও একটি মৌন সমর্থন বিদ্যমান—বহু পেশাজীবী মনে করছেন, বন্দর বেচাকেনার বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার নয়। তাদের নীরবতা সরকারপন্থি নয়, বরং আতঙ্কপ্রসূত—চাকরি হারানো, মামলা খাওয়া কিংবা একঘরে হওয়ার ভয়। এ নীরবতা কোনো সময়েই স্থায়ী হয় না। ইতিহাস বলে, যখন জনগণ সরাসরি না বলে তখনো তারা তলে তলে প্রস্তুত হয়।
চীন একটি পরিপূর্ণ উদাহরণ—কৌশলগত প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রেখে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনসটিটিভের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছে বটে, তবে নিজের কৌশলগত স্থাপনা কখনো বহির্বিশ্বের হাতে দেয়নি। বন্দর, রেল, জ্বালানি—সবই তারা রাষ্ট্রীয় নীতিতে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। বাংলাদেশও চাইলে একটি রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা তৈরির কৌশল নিতে পারে। কেননা বন্দর মানে শুধু লোড-আনলোড নয়, এটি ভূরাজনীতির প্রবেশদ্বার, সামরিক কৌশলের চাবিকাঠি।
এ লড়াই কেবল বামপন্থিদের নয়। এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের। যে রোডমার্চ আজ কিছু সংখ্যক মানুষ করছেন, কাল তা হতে পারে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন।
চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি বন্দর নয় এটি আমাদের রাষ্ট্রের শেষ সীমানা। একে হারানো মানে কেবল রাজস্ব নয়, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অধিকারও বিসর্জন দেওয়া।
ড. ইউনূস হোক বা দাতাগোষ্ঠী যারাই বলুক, ‘বিদেশিরা পারে’—আমাদের জবাব হওয়া উচিত, ‘আমরাও পারি, যদি রাষ্ট্র চায়।’
বাংলাদেশের রোডমার্চ ঐতিহাসিকভাবে কখনোই রাষ্ট্র কাঁপিয়ে দেয়নি, কিন্তু তারা প্রশ্ন তুলেছে। আর প্রশ্নই তো গণতন্ত্রের প্রাণ। আজকের রোডমার্চ হয়ত জনসমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে না, কিন্তু ভবিষ্যতের প্রতিরোধ ও নীতিগত চিন্তার ভিত্তি হয়ে থাকতে পারে। প্রশ্ন একটাই : আমরা কি শুধু উন্নয়নের কথা বলব, না রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের প্রশ্নগুলোতে সত্যিকারের জনসম্পৃক্ততা চাইব?
লেখক : সাংবাদিক ও কবি
কেকে/এএম