চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে একাট্টা হয়ে উঠছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট। বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি জাপান সফরকালে দেওয়া এক মন্তব্য- ‘একটি দল ছাড়া আর কেউ ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় না’, এটি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
এর মধ্যে বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণফোরাম, এলডিপি, ১২ দলীয় জোটসহ বিএনপি নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত প্রায় সব দলই এ বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। তারা বলছেন- ড. ইউনূসের এ মন্তব্য রাজনৈতিক বিভাজন তৈরির অপচেষ্টা এবং নির্বাচন বিলম্বিত করার দুরভিসন্ধিরই প্রতিফলন। এ ছাড়া ড. ইউনূসের এই মন্তব্যের বিরোধিতা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে দলগুলো।
গণফোরাম : গণফোরাম বলেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাপান সফরে গিয়ে একটি দল ছাড়া আর কোনো দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় না বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা সঠিক নয়। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছে বলেও উল্লেখ করেছে দলটি। গতকাল শুক্রবার বিকালে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গণফোরামের সভাপতি পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। গণফোরামের সভাপতি পরিষদের অন্যতম সদস্য এস এম আলতাফ হোসেনের সভাপতিত্বে সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান, সভাপতি পরিষদের সদস্য সুব্রত চৌধুরী, জগলুল হায়দার আফ্রিক, মেজবাহউদ্দীন, মোশতাক আহমেদ, সুরাইয়া বেগম, সেলিম আকবর, শাহ নুরুজ্জামান প্রমুখ।
সভায় আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরে গণফোরামের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টার বক্তব্য অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে এবং এর ফলে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরির প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
গণফোরামের নেতারা বলেন, গণঅভ্যুত্থানের সুফল পাওয়ার জন্য দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা জরুরি। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের রূপরেখা ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এ দায় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে দুঃখজনক।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের আলোচনা এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের বৈঠক জাতিকে আরো হতাশ করেছে বলে উল্লেখ করেছে গণফোরাম। দলটি বলেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার এবারের বৈঠকে গণফোরামকে আমন্ত্রণ না জানানোর ফলে সরকার ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।
বাম গণতান্ত্রিক জোট : বাম গণতান্ত্রিক জোট বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে, অন্তর্বর্তী সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ‘এজেন্ডা বাস্তবায়ন’ এবং ‘সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়’ নবগঠিত দলকে রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়ার জন্য নির্বাচন পেছানোর অপকৌশল নিয়েছে। একই উদ্দেশ্যে ‘সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়’ নবগঠিত একটি রাজনৈতিক দল এবং ৭১-এর যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী কতিপয় উগ্র সাম্প্রদায়িক দল ও গোষ্ঠী নির্বাচন বানচাল করতে দেশে অস্থিতিশীল-নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির নানা রকম অপতৎপরতা চালাচ্ছে। যা দেশকে ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত করবে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষে এ বিবৃতি দিয়েছেন জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ, সিপিবির সভাপতি মো. শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টির নির্বাহী সভাপতি আবদুল আলী।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি : লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশের সব দল নয়, মাত্র একটি রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন চায় বলে দাবি করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আমি বলব, তার বক্তব্য সঠিক নয়। বাংলাদেশ একটি দল নয়, কমপক্ষে ২০টি নিবন্ধিত দলসহ প্রায় সব দলই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। এলডিপিসহ বিএনপি নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে শরিক সব দল চায় ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। এ নিয়ে টালবাহানার কোনো সুযোগ নেই। শুক্রবার এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেন এলডিপি মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ।
রেদোয়ান আহমেদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা শুরু হয়েছে। আমরা অন্য কোনো কথা শুনতে চাই না, জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই হতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ ছিল দেশের বিশৃঙ্খল অরাজক পরিস্থিতিতে থামিয়ে যত দ্রুত সম্ভব জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষা ছিল একটি বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এ সরকার সেই পথে না হেঁটে ক্ষমতায় থাকার রাস্তা পাকাপোক্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত। তিনি আরো বলেন, ৯ মাসে সরকার কী সংস্কার করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ৬৬৬ কোটি টাকা সুদ মওকুফ। ৪ হাজার কোটি টাকা গ্রামীণ ফোনের মওকুফ। স্টারলিংকে গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ ফোনের অংশীদার। এটিকে কী আমরা সংস্কার বলব।
রেদোয়ান আহমেদ বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা দিয়েছেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত করতে এর বিকল্প নেই। এই ৩১ দফার মধ্যেই রয়েছে রাষ্ট্র মেরামতের যাবতীয় উপাদান। ৩১ দফা শুধু বিএনপির নয়, এটা বিগত স্বৈরাচার আমলে রাজপথে থাকা সকল গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দলের। ৩১ দফা এই সরকার বাস্তবায়ন করলে আর কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হবে না।
১২ দলীয় জোট : ‘ডিসেম্বরে মাত্র একটি দল নির্বাচন চায়’ প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে ১২ দলীয় জোটের নেতারা বলেছেন, এ বছরের ডিসেম্বরে কেবল একটি দল নয়, দেশের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল নির্বাচন চায়। নির্বাচনই এ দেশের মুক্তি ও উন্নতির অভিমুখ নিশ্চিত করে। বারবার তা প্রমাণিত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ১২ দলীয় জোটের নেতারা এ কথা বলেন। জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম এদিন দুপুরে এ বিবৃতির কথা নিশ্চিত করেন।
জোটের নেতারা বলেন, কেবল একটি দলই নয়, দেশের সব গণতন্ত্রপন্থি দলগুলো স্পষ্টভাবে গত নয় মাস ধরে ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলে এসেছে। বরং তিনি নিজেই কিছু মৌলবাদী, জনসমর্থনহীন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দলকে পাশে নিয়ে নির্বাচনের প্রশ্নটিকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেছেন।
১২ দলীয় জোটের নেতারা আরও বলেন, ১২ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে দফায়-দফায় এ বছরের জুনের মধ্যেই নির্বাচনের কথা বলেছি। দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো সভা, সমাবেশ, সেমিনার, বক্তব্য, বিবৃতি এবং প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বারবার এ কথা উচ্চারণ করেছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস হয়তো ভুলে যাচ্ছেন তিনি কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে তার গদি রক্ষা করতে পারবেন না। পদত্যাগের নাটক করেও পারবেন না। বাংলাদেশের জনগণ তার নাটক বুঝে গেছে।
জোটের নেতারা বলেন, আগামী ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন করা সম্ভব। দেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও নানাভাবে বিষয়টি সামনে এসেছে। আমরা চাই দেশের জনগণের দীর্ঘদিনের চাওয়া তিনি পূরণ করবেন। তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অন্তর্বর্তী কাজ করার জন্য, স্থায়ী কোনো কাজ নয়। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া, ন্যূনতম সংস্কার করে নির্বাচন করতে হবে। আগে প্রয়োজন নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা। পাশাপাশি চলবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বিচার। ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়া চলমান হয়েছে। অবিলম্বে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করে দেশকে মহাসংকটের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানান ১২ দলীয় জোট নেতারা।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গে টেনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, খুব দুঃখের সঙ্গে বলছি, দেখলাম ইউনূস সাহেব জাপানে বসে বিএনপির সম্পর্কে বদনাম করছেন। একটু লজ্জাও লাগলো না, দেশের সম্পর্কে বিদেশে বসে বদনাম করতে? তিনি বললেন, ‘একটি দল নির্বাচন চায়, আর কেউ চায় না’। আর আমরা (বিএনপি) বলতে চাই, একটি লোক নির্বাচন চান না, তিনি হলেন ড. ইউনূস। উনি নির্বাচন চান না।
অন্যদিকে দেশের সমস্যার কথা বাইরে গিয়ে বললে সমাধান মিলবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুরে এলজিইডি মিলনায়তনে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকীর আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের অপেক্ষায় আছি। নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় আছে দেশের জনগণ। কারণ, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত আমরা যত কথাই বলি, কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশে একটা নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন।’
জাপানে নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এটা (নির্বাচন) কোন দল চায় বা না চায়, এটা বড় কথা না। গণতন্ত্রের প্রত্যাশায় মানুষ আছে। কোনো কথা বললে আমরা দেশের মধ্যে বললেই ভালো। দেশের বাইরে গিয়ে বেশি কথা না বলে দেশের ভেতরে বললে, এটা তো বাংলাদেশের সমস্যা, এ সমস্যার কথা তো বাইরে গিয়ে বলে লাভ হবে না। বাংলাদেশের মধ্যে বলে এখানেই সমাধান করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বারবার বিদেশে গিয়ে, বাইরে গিয়ে যদি এসব বলতে থাকি, তাহলে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হবে? এখানে বলতে হবে, এখানেই সমাধান এবং বাংলাদেশের মানুষই সমাধান।’
কেকে/এআর