চায়ের রাজ্য ও পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল শহরের সবচেয়ে পুরনো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে কলেজ রোডের ময়লার ভাগাড়। ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রীমঙ্গল পৌরসভা ২০০২ সালে প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় উন্নীত হলেও আজো একটি স্থায়ী ময়লার ডাম্পিং স্টেশন গড়ে ওঠেনি। ফলে প্রায় ৯০ বছর ধরে শহরের আবর্জনা ও মানববর্জ্য ডাম্প করা হচ্ছে কলেজ রোডের খোলা জায়গায়। যার ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী, শিক্ষক, মসজিদের মুসল্লি ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ ও আবাসিক এলাকার সংলগ্ন এই জায়গাটিকে নিয়মিত ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করছে পৌরসভা। ফলে প্রতিদিন এখানে ফেলা হচ্ছে পচা-গলা খাবার, প্লাস্টিক, পলিথিনসহ নানা ধরনের কঠিন বর্জ্য। এসব বর্জ্যের দুর্গন্ধে তিনটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী ও শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে নাক-মুখ চেপে ক্লাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। ধোঁয়া ও মশা-মাছির উৎপাতও তাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
২০১৮ সাল থেকে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন, স্মারকলিপি ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে ভাগাড় স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে আসলেও আজ পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, সাবেক এমপি, মন্ত্রী, মেয়র, ডিসি ও ইউএনও সবাই শুধু আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু কেউই বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে আসেননি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ভাগাড়ে পৌরসভার ময়লাবাহী গাড়ি এসে নিয়মিতভাবে ময়লা ফেলছে, যার চারপাশে নেই কোনো সীমানা প্রাচীর বা নিরাপত্তাব্যবস্থা। পথশিশু, কুকুর, বিড়াল, এমনকি গরু-ছাগলও অবাধে বিচরণ করছে সেখানে। ময়লার দুর্গন্ধে আশপাশের আবাসিক এলাকা যেমন বসুন্ধরা, সেখানে বসবাসরত কয়েক হাজার মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন।
শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী নাফিসা আক্তার বলেন, কলেজ ক্যাম্পাস কিংবা ক্লাস রুম, সব জায়গায় ময়লার গন্ধ বাতাসে ভেসে আসে। ক্লাসের ভেতরও আমাদের নাকে-মুখে রুমাল চেপে বসতে হয়। ময়লার উৎকট গন্ধে কলেজে ক্লাস করা মুশকিল। বিষয়টি সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিবেচনা করে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
কলেজ রোডের বাসিন্দা সাহেনা বেগম জানান, ঘরের সামনে পৌরসভার আবর্জনার ভাগাড়। ভাগাড়ে নিয়মিত আগুন দেওয়ার কারণে ধোঁয়ায় আমাদের নাক-মুখ ও গলা জ্বলে। তাই নিয়মিত নাক-মুখ চেপে যাতায়াত করতে হয়।
কলেজ সড়ক দিয়ে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন অটোরিকশাচালক সুজন মিয়া। তিনি বলেন, এই সড়ক দিয়ে যাত্রী বহন করতে গিয়ে ক্ষতিকর ধোঁয়া ও আবর্জনার দুর্গন্ধ প্রতিদিন সহ্য করতে হয়। স্থানীয় বাসিন্দা বৃদ্ধ আবুল হোসেন বলেন, ময়লার উৎকট দুর্গন্ধ বাতাসের সঙ্গে মিশে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ছড়িয়ে পড়ছে। বৃস্টি আসলে ভাগাড়ের ময়লার দুর্গন্ধে এখানে থাকাটা দায়।
শ্রীমঙ্গল পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে শহরতলীর জেটি রোড এলাকার ভাড়াউড়া মৌজায় ২.৪৩৮৩ একর জমি কিনে সেখানে ময়লার ভাগাড় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে সেখানে ময়লার ভাগাড় স্থাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ান উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ভানু লাল রায়।
এ ছাড়া তৎকালীন জমিতে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের সময় ওই এলাকার এক ব্যক্তি আদালতে মামলা করেন। এই মামলার প্রেক্ষিতে আদালত ২০২৩ সালের ১৩ মে পর্যন্ত কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। আদালতের নিষেধাজ্ঞায় পৌরসভা থেকে উদ্যোগ নেওয়া ময়লার ভাগাড় স্থানান্তরের কাজটি বন্ধ হয়ে যায়।
শ্রীমঙ্গল পৌরসভা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ময়লার ভাগাড় স্থানান্তরের জন্য নতুন করে নেওয়া প্রকল্পের জন্য ড্রইং, ডিজাইন ও বাজেটসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ঊর্ধতন কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও শ্রীমঙ্গল পৌর প্রশাসক মো. ইসলাম উদ্দিন খোলা কাগজকে বলেন, আমি শ্রীমঙ্গলে আসার পর শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা দুর্ভোগের বিষয়টি আমাকে জানালে সরেজমিনে ভাগাড়ের স্থানটি আমি পরিদর্শন করি। ময়লার ভাগাড় স্থানান্তর করে ‘স্যানেটারি ল্যান্ড ফিল্ড এবং ফ্যাকাল স্ল্যাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ স্থাপনের জন্য ২১ কোটি ২৮ লাখ ৩০ হাজার টাকার একটি প্রজেক্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদফতরকে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ইউএনও আরো বলেন প্রজেক্ট অনুমোদন হয়ে আসলে ময়লার ভাগাড় স্থানান্তর করে সদর উপজেলার জেটি রোডস্থ ভাড়াউড়া এলাকায় অথবা উপযুক্ত কোনো স্থানে স্যানেটারি ল্যান্ড ফিল্ড এবং ফ্যাকাল স্ল্যাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ শুরু করা হবে। এতে অন্তত পৌরসভা ও শহরতলীর ৫০ হাজার বাসিন্দা উপকৃত হবেন।
কেকে/এএম